ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার তদন্ত ও বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছিল ইউরোপের ১৩ দেশ। সেই দেশগুলোর বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের আজ বুধবার তলব করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভবিষ্যতে তারা যাতে এ ধরনের কাজ না করেন সে বিষয়ে তাদের সতর্ক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১৩ দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘গত ১৭ জুলাই, ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমকে কেন্দ্র করে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ঢাকাস্থ যে সব দূতাবাস গণমাধ্যমে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল, আজ দুপুরে তাদের রাষ্ট্রদূতদের আমরা ডেকেছিলাম। তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণে আমরা আমাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছি।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি যে, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা দিয়ে সারাদিনের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। আপনারাও জানেন যে, ওই নির্বাচনে সহিংসতা হয়নি। জনাব আলম সারাদিন আপনাদেরই (সাংবাদিকদের) সতীর্থদের সঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্র অবাধে বিচরণ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোট শেষ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনিও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হননি, বা কোনো অভিযোগ করেননি। অন্যান্য প্রার্থীরাও কোনো ধরনের সহিংসতা বা অন্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ করেননি।’
তিনি বলেন, ‘তাই শুধুমাত্র একটি কেন্দ্রের শেষ মুহূর্তের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাটিকে গুটি কয়েক কূটনীতিক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা কখনোই সারাদিনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রতিফলিত করে না। দ্রুত একটি প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তারা তাদের মুল্যায়নটির বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেননি।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঘটনা সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশন এবং সরকার ত্বরিত ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। ১৯ জুলাই কূটনীতিকদের বিবৃতি দেয়াওর অনেক আগেই কিন্তু দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই তারিখে আপনারাও তা মিডিয়াতে প্রকাশ করেছিলেন। অথচ, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারর পরেও এই কুটনীতিকরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন যা অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়।’
তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, যে দ্রুততা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা তারা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু তারা সরকারের গৃহীত তাৎক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থাকে তারা মূল্যায়ন করেননি। তাই, যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আবার দেখুন, যাকে কেন্দ্র করে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটলো সেই জনাব আলম কিন্তু ঠিকই পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন এবং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাৎক্ষণিক উদ্যোগ এবং ব্যবস্থা গ্রহণকে সাধুবাদ জানিয়ে পূর্ণ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ওনাদের যৌথ বিবৃতিটি যে ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে যথা সময়ের অনেক আগেই তড়িঘড়ি করে অপরিনতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আশা করি, আমাদের আজকের আলোচনার পর তারা সেটি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন এবং ভবিষ্যতে এমন অকূটনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকবেন। এ কারণে, আজকে আমরা তাদের কূটনৈতিক আচরণবিধি সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে গঠনমূলক হবার পরামর্শ দিয়েছি। পাশাপাশি এ-ও সতর্ক করা হয়েছে যে, সরকারকে পাশ কাটিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতা বর্জিত আচরণ কেবলই পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে।’
এ তলবের ফলে পারস্পরিক সম্পর্কে ফাঁটল ধরবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘মোটেই নয়, আপনারা জানেন এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, যুক্তরাজ্য আছে, ইউরোপের বেশকিছু দেশ আছে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও একটি দেশ সফর করছেন এবং আপনারা এতদিনে নিশ্চয় জানেন যে বন্ধুত্বের বা কার্যকরী সম্পর্ক বা সেই সম্পর্কগুলোর এই ধরনের কোনো বিষয় থাকলেও এগিয়ে যেতে পারে বা এগিয়ে যায়। এমনকি প্রতিবেশীর মধ্যেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে বার্নিং ইস্যু থাকে, তবুও অন্যান্য কার্যকরী বিষয়কে এগিয়ে নেওয়া হয়।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেইভাবেই উদাহরণটি দেব আমি, এই প্রতিটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, পিপলস টু পিপলস যোগযোগ আছে, থিঙ্ক ট্যাংক লেভেলে যোগাযোগ আছে। এই যোগাযোগগুলো আমাদের সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা, অপচেষ্টা থাকে, যার ফলশ্রুতিতে এ রকম ঘটে থাকতে পারে। কারও অতি উৎসাহী ভাব থেকে এরকম হয়ে থাকতে পারে, জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধির (আবাসিক সমন্বয়কারী) ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এই বিষয়গুলো তারা তাদের লেভেলে প্রসেস করতে না পারলেও ক্যাপিটালগুলো…, আমি উদাহরণ দিতে চাই না আপনারা বুঝতে পারবেন যে এর আগেও আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন একটি দেশের রাষ্ট্রদূত কমেন্ট করেছিলেন, যেটি তাদের ক্যাপিটালের কমেন্ট ছিল না। সে কারণে তাকে আমরা তলব করেছিলাম এবং পরে সেই দেশের সঙ্গে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময় হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তারা (১৩ দেশের রাষ্ট্রদূত) তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে উদাহরণ দিয়ে বলেছি যে তোমরা যদি ধরে নাও বা বল বা আহ্বান কর যে, তাদের যে ল্যাঙ্গুয়েজটি ছিল যে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং বিচার হবে। আপনারাও খেয়াল করবেন যে এই ব্রিফ স্টেটমেন্টে তারা কিন্তু উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে তারা যেই তারিখে ইস্যু করেছেন তার আগের দিনই আমরা দুইজনকে গ্রেপ্তার করে ফেলেছিলাম। সেটা তারা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা ভিয়েনা কনভেশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা এটা তাদের স্মরণ করে দিয়েছি এবং বলেছি যে কোনো ইস্যুতে গণমাধ্যমে কথা বলতে পারেন, আমাদের কোনো আপত্তি নাই কিন্তু প্রথমেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে সেটা পরিষ্কারভাবে ফোরটি ওয়ান টুতে (ভিয়েনা কনভেনশনের ধারা) বলা আছে।’
আপনার কাছে কি মনে হয় সরকার অনেক পরে এসে এমন অবস্থানে গেল? নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা বিদেশি কূটনৈতিকরা বলে যাচ্ছেন, গত ২০ বছর ধরে আমরা দেখছি। নতুন করে সরকার কেন এমন অবস্থানে গেল?- এমন প্রশ্নে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘ না, এটা নতুন না। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে আমি দুই-একটা উদাহরণ দিলাম, আমরা ইনডিভিজ্যুয়াল লেভেলে, একসঙ্গে বেশ কয়েটি রাষ্ট্র এর আগে করেনি। এখানে তাদের ফান্ডামেন্টাল কিছু ফলস আছে, মিডিয়া স্টেটমেন্টে। সেগুলো তুলে ধরেছি। যখনই এ ধরনের ঘটনা আসবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সেটা তখনই করব, এর আগেও করেছি আমরা। এর ধারাবাহিকতা আছে, র্যানডম কিছু নয়।’
বিদেশ দূতাবাসে যে স্টেটমেন্ট পাঠানো হবে তা কি তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না কি আমাদের (বাংলাদেশের) অসন্তুষ্টির কথা বলা হবে?- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের অসন্তুষ্টি জানিয়ে দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে তাদের দূতাবাসের কেউ-ই এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত না হন সে আহ্বান থাকবে।’
মাঝেমধ্যেই বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তলব করছেন , কিন্তু তারা এমন কথা বলেই যাচ্ছেন। তারা কী আপনাদের কথা কর্ণপাত করছেন না?- এ প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যাটা কোথায়, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই বোধ হয় ভালো উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আমার মনে হয় আমরা রেজাল্ট পেয়েছি। দেশের নাম উল্লেখ করে বলাটা ঠিক ডিপ্লোম্যাটিক নর্মসের মধ্যে পড়ে না, কিন্তু আপনি যদি কিছু দেশ ধরে কিছুটা অ্যানালাইসিস বা গবেষণা করার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি পাবেন। আমরা আশা করি আজকের পরে এই দেশগুলোও আর এ ধরনের কর্মকাণ্ড করবে না।’