বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা দেশের ব্যক্তিমালিকাধীন কিন্ডারগার্টেন (কেজি স্কুল) নিয়ন্ত্রণে আসছে নতুন বিধিমালা। নতুন এই নিয়মনীতির আড়ালে মূলত কেজি স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সরকারি খড়গ। সরকার যদিও দেশের সব কেজি স্কুলকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য এই বিধিমালা প্রণয়ন করছে; কিন্তু মালিকপক্ষ বলছে, এখানে অনেক শর্তই কঠিন করা হয়েছে। তাই তারা বেশ কিছু বিষয়ে সংশোধনীরও দাবি জানিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিকের দাবি- সরকারের এই উদ্যোগ সফল করে অর্থাৎ কেজি স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য আলাদা একটা অধিদফতর অথবা অধিদফতরের আলাদা একটা বিভাগ করা হোক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কেজি স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি বিধিমালা প্রণয়নের কাজ প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। সেই বিধিমালার আলোকে ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন এলাকার ২০০ কেজি স্কুল নিবন্ধনও পেয়েছিল। পরে অবশ্য ১৯৯১ সালে সেই বিধিমালা পুরোটাই বাতিল করা হয়। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর এ বিষয়ে আর কোনো নতুন বিধিমালা হয়নি। পরে সর্বশেষ ২০১১ সালে আবারো নতুন বিধিমালার আওতায় কেজি স্কুলগুলো নিবন্ধনের জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়। তবে বেশ কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেই নিবন্ধন প্রক্রিয়াতেও নানা ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। ফলে আটকে যায় নিবন্ধনের কাজ।
বর্তমানে নতুন করে আবারো কেজি স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে বিধিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এখন থেকে অনুমতি ছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয় তথা কোনো কেজি স্কুল আর পরিচালনা করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না ইচ্ছেমতো ফি। খাত ও ফি’র হার থাকবে নির্দিষ্ট। দেশে এখন চালু থাকা ৬০ হাজারের বেশি কেজি স্কুলের প্রত্যেকটিকেই নিতে হবে নিবন্ধন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠানও পূর্ব অনুমোদন ছাড়া পরিচালনা করা যাবে না।
এ দিকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেশ কিছু নতুন ও পুরনো শর্তের আলোকে কেজি স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ বেশ অনেকদূর এগিয়েছে। অনুমোদন প্রক্রিয়া, পরিচালনা ম্যানুয়াল এবং ফি-সংক্রান্ত অনেকগুলো শর্ত দিয়ে এই বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ ধরনের নানা রকম বিধান রেখে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) নিবন্ধন বিধিমালা তৈরি করছে সরকার। অনুমোদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বর্তমানে এটি খসড়া হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আছে। এই প্রক্রিয়া শেষে এর খসড়া যাবে মন্ত্রিসভায়। সেখানে চূড়ান্ত অনুুুমোদন পেলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই বিধিমালার আলোকে নিবন্ধন নিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে দেশের সব কেজি স্কুলকে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কিন্ডারগার্টেন-সহ (কেজি) বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের স্কুল তত্ত্বাবধানের জন্য ২০১১ সালের একটি বিধিমালা ছিল। তবে সেটি যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। বিশেষ করে অধিভুক্তি আর রেজিস্ট্রেশনের দিক সহজ করাসহ বিভিন্ন দিকে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে তত্ত্বাবধান করতে চাইলে আইনি ভিত্তি প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন সামনে রেখে এবারের বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। বিধিমালা কেউ প্রতিপালন না করলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত নতুন বিধিমালার আওতায় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানকারী নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি স্কুল এবং অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তার (টিইও) মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদন ফি মেট্রোপলিটন ও অন্য বিভাগীয় শহরে পাঁচ হাজার, জেলায় তিন হাজার, উপজেলায় দুই হাজার টাকা জমা দিতে হবে। তিনি যাচাই শেষে তা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে পাঠাবেন। তিনিই প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা চলমান প্রতিষ্ঠান চালু রাখার চূড়ান্ত অনুমতি দেবেন। আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদন বা বাতিল করতে হবে। প্রাথমিক অনুমতির মেয়াদ হবে সনদ দেয়ার পর থেকে এক বছর। এই মেয়াদ শেষ হলে নবায়নের আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। আর পূর্ব তদন্ত ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান নবায়ন করা যাবে না।
নতুন বিধিমালার আওতায় প্রাথমিক অনুমোদনের পর নিতে হবে নিবন্ধন। শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্কুল নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। জেলায় ১০ হাজার এবং উপজেলায় আট হাজার টাকা। নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি, উপস্থিতি এবং শিক্ষা সমাপনের হার বিবেচনায় নেয়া হবে। অনুমোদন বা অনুমতি কর্তৃপক্ষ ডিপিইও হলেও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ হবেন বিভাগীয় উপ পরিচালক (ডিডি)। নিবন্ধনের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। নিবন্ধন সনদে নানা শর্ত উল্লেখ থাকবে। পাঠদান অনুমতি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন না নিলে অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে। নিবন্ধন সনদ প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষণ করতে হবে।
বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, বর্তমানে কেজি স্কুল ব্যক্তিগত সম্পদের মতো পরিবারের সদস্যরা পরিচালনা করছেন; কিন্তু প্রত্যেক স্কুলের একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। কমিটিই চালাবে প্রতিষ্ঠান। এতে প্রধান শিক্ষক, একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, একজন অভিভাবক প্রতিনিধি, উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে দু’জন থাকবেন। প্রতিষ্ঠাতা পাওয়া না গেলে ইউএনও বা ডিসির দু’জন প্রতিনিধি থাকবেন। এ ছাড়া থাকবেন নিকটতম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক। প্রতিনিধি নির্বাচনে ভূমিকা রাখবেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। বিদ্যালয়ের সংরক্ষিত ও সাধারণ নামে দু’টি তহবিল থাকবে। সংরক্ষিত তহবিলে এলাকা অনুযায়ী স্থায়ী আমানত বা সঞ্চয়পত্র আকারে থাকতে হবে। এর মধ্যে আছে- মেট্রোপলিটনে এক লাখ, জেলায় ৭৫ হাজার, উপজেলা ও পৌরসভায় ৫০ হাজার এবং ইউনিয়নে ২৫ হাজার টাকা। বিদ্যালয় ভাড়া কিংবা স্থায়ী বাড়িতে হোক, মেট্রোপলিটন এলাকায় অন্যূন দশমিক ৮ একর, পৌরসভায় দশমিক ১২ এবং অন্য এলাকায় দশমিক ৩০ একর ভূমিতে হতে হবে। ভবন ও ভূমি ভাড়া নেয়া যাবে। তবে এ বিধিমালার আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ভূমির পরিমাণ কম হলে সে ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।
২০১১ সালে প্রণীত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধন বিধিমালা রিভিউ কমিটির অন্যতম সদস্য ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো: মিজানুর রহমান সরকার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সবসময়ই বিধিমালার পক্ষে। তবে নতুন করে যে বিধিমালা হচ্ছে এখানে কিছু শর্তের মধ্যে জটিলতা রয়েছে; এগুলো আমরা সংশোধন কিংবা পরিবর্তন করতে বলেছি। বিশেষ করে নিবন্ধন ফি’ ও স্থায়ী ব্যাংক তহবিলে টাকার পরিমাণ কমাতে হবে। এ ছাড়া কমিটিতে পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছি। একই সাথে প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত ভূমির পরিমাণের বিষয়টিও প্রদেয় শর্তের আলোকে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রীর সাথে দেখা করে বিষয়গুলো আমরা লিখিত আকারে তুলে ধরেছি। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, ২০১১ সালেও যখন বিধিমালার আলোকে কেজি স্কুলগুলোকে নিবন্ধন দেয়া শুরু হয় তখনো নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে বিধিমালা মোতাবেক একটি ফাইল তৈরি করে, পরিদর্শন করিয়ে অধিদফতর পর্যন্ত প্রেরণ করতে একটা স্কুলের পরিচালকের অনেক টাকা, শ্রম, মেধা ব্যয় হয়েছিল। অনেক কষ্টের পর ফাইলটি তৈরি করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিধিমালা মোতাবেক সব কাগজপত্র ঠিক আছে কি না যাচাই করে স্কুলটি পরিদর্শনপূর্বক উপ পরিচালক প্রতিবেদন সহকারে ফাইলটি রাষ্ট্রীয় ডাকে অধিদফতরে প্রেরণ করেন। তারপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিদফতর থেকে এ রকম শত শত ফাইল গায়েব হয়ে যায়। স্কুলের ফাইল গায়েব হওয়ার কারণে অনেকে পড়েছেন ভোগান্তিতে।
চট্টগ্রামের কয়েকটি স্কুলের মালিক জানিয়েছেন, নিবন্ধনের জন্য তারা ২০১৬ সালে ফাইল জমা দিয়েছেন; কিন্তু ফাইল হারিয়ে এখনো চেষ্টা তদবির করছেন তাদের ফাইল উদ্ধারের জন্য। এমন কয়েকটি স্কুল হলো- চট্টগ্রামের সারজন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বি এইচ নলেজ ফেয়ার স্কুল, ফেয়ার কেয়ার কিন্ডারগার্টেন স্কুল, আর এস আর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বসুন্ধরা মডেল স্কুল।
নতুন বিধিমালার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ ফরিদ আহম্মদের সাথে যোগাযোগের চেষ্ট করা হলে জানানো হয়েছে- তিনি এখন হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে রয়েছেন। তবে একই মন্ত্রণালয়ের একজন উপ সচিব জানিয়েছেন, এই বিধিমালাটি এখন যেহেতু জনপ্রশাসনে রয়েছে কাজেই আমরা কেজি স্কুলের মালিকদের দাবিগুলো বিবেচনায় রাখছি। বিধিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে আপত্তি পাওয়া শর্তগুলোর বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।