বলা সহজ করা কঠিন

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


নতুন আয়কর আইন। ২০২৩ সালের ১২ আইন। সূতিকাগার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। সংসদে ৮ জুন নতুন আয়কর আইন প্রস্তাব পেশ করা হয়। তা কণ্ঠভোটে পাস হয় ১৫ জুন এবং এতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে ২২ জুন ‘অবিলম্বে কার্যকর’ দেখিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এখন এই আইনের প্রকৃত প্রয়োগ ও এখতিয়ার নিয়ে ব্যাখ্যার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ‘কর পরিপত্র-১’ জারি পর্যন্ত। সংসদে উপস্থাপন না করে বাজেট অধিবেশনের মাসখানেক আগে এসআরও জারির মাধ্যমে ‘করদাতা সংগ্রহ ও সহায়তাকারী’ নিয়োগের যে জটিল পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বা হবে, সেটিরও আইনগত ভিত্তি এবং প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা এ বিষয়টি না নতুন আইনে, না অর্থবিলে আনা হয়েছে। সংসদের বাইরে ‘এসআরও’ জারির মাধ্যমে শুল্ককরাদি আইন প্রথা-পদ্ধতিতে মোটা দাগের পরিবর্তন আনার যৌক্তিতা ও যথার্থতা নিয়ে করদাতাদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। কর রাজস্ব আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে কোনো ধোঁয়াশার সুযোগ, স্বেচ্ছা ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার, মেধাবী ব্যাখ্যার প্রয়োগে দোদুল্যমানতা, অস্পষ্টতায় কর আহরণে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার, প্রতিবিধান পাওয়ার জন্য পর্যপ্ত ব্যবস্থা যথা আপিল, ট্রাইব্যুনাল, এমনকি কর ন্যায়পাল অফিসের ভূমিকা ও কার্যকারিতা করদাতাবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক ও আয়কর আইনে কর ন্যায়পালের প্রভিশন না থাকার যুক্তিতে ২০১১ সালে ২০০৫ সালের পাস করা কর ন্যায়পাল আইন রহিত করা হয়। নতুন আয়কর আইনে কর ন্যায়পালের নাম-গন্ধ নেই। আয়কর আইনকে করদাতাবান্ধব করার যে প্রচার, নতুন আইনের মধ্যে কর অফিসকে বেশকিছু দায়মুক্তি দেওয়ার বিধান যোগ হওয়ায় তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দেশে একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর প্রদান পরিবেশ গড়ে তোলার আকিঞ্চন আকাক্সক্ষা প্রয়োগকারী কর্তৃক প্রণীত নতুন আইন নীতিনির্ধারক কর্তৃক তড়িঘড়ি করে বিনাবাক্য ব্যয়ে পাস হওয়ায় ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হেরে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশে বিদ্যমান অধুনা প্রতিস্থাপিত ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটি প্রতীয়মান হয়Ñ বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোঁটা শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন ও মূল ধারণার আওতায় প্রয়োগযোগ্যতার মাপকাঠির পরিবর্তন বা পরিমার্জন অনুমোদিত হয়েছে, তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২ সালের মূল আইনের ভাব-ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন কিংবা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না; বরং প্রতিবছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা অথবা এখতিয়ার, কর অবকাশ-নিষ্কৃতি, ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় এবং করদাতার অধিকার, কর অবকাশ-নিষ্কৃৃতি ও সুবিধা সংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে বিভ্রান্ত, বিকৃত এবং বিস্মৃত। পক্ষান্তরে যুগ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ-সরলীকরণ তথা করদাতা বান্ধবকরণের পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ সংবলিত সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গেছে। প্রতিবছর নতুন নতুন সংশোধনী আনায় এসবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই অনেক দিন ধরে নতুন আয়কর আইন করার পরিকল্পনা ছিল।

ভারত ১৯৫৫ সালে তাদের আইন কমিশনকে ১৯২২ সালের আয়কর আইনটি যুগোপযোগী করার দায়িত্ব দেয়। কমিশন তিন বছর পরীক্ষার পর আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য সরকারের কাছে জমা দেয়। রাষ্ট্রপতি এটি পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেন এবং পার্লামেন্ট আরও দুই বছর সময় নেয়। কারণ বিষয়টি এত সহজ ছিল না যে, সংসদে উপস্থাপন করলেই সেটি পাস করতে হবে। এটি এমন একটি আইন যা যুগ যুগ ধরে চলবে। ভারতীয় পার্লামেন্ট বিভিন্ন জরিপ ও জনমত যাচাই করে এক্সপার্টদের পরামর্শ নিয়ে ১৯৬১ সালে আইনটি পাস করে। বাংলাদেশ সেখানে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আইনটি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যাই কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে। সরকার ১৯৭৯ সালে এনবিআরের সাবেক সদস্য ও কয়েকজন কনসালট্যান্টের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে খসড়া আইন তৈরি এবং ১৯৮৪ সালে স্বাভাবিক সেটিকেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে গ্রহণ করে। ১৯৮৪ সালে যে আইনটি করা হলো, সেটিও ছিল ইংরেজি ভাষায়। এটি ছিল ১৯২২ সালের ব্রিটিশদের করা আইনের সংশোধন মাত্র।

কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অবস্থান কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের (যারা উত্তরাধিকার সূত্রে একই কর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পেয়েছে) তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এটির অন্যতম কারণ হলো অন্যসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়ন। যেমন ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের ১০ বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করে নেয়। ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পর পর তাদের রাজস্ব আহরণ আইনকে রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ভারত ভাগের ৩১ বছর পর ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। এটি যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস ও প্রবর্তনের কসরত চলছে দেড় যুগ ধরে। বাংলাদেশ ও ভারতের করব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে বড় একটি প্রশাসনিক পার্থক্য হলো, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর, এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীন। ভারতে তা নয়। সেখানে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন ও থ্রেসহোল্ড দেওয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং একটি শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে, তেমনি রাজ্যপর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ও ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন এবং প্রয়োগের সুযোগ।

আরেকটি হলো হিসাব সংরক্ষণ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে। কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সব মিলিয়ে দেশগুলোয় একটি টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও ওই সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি ও নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশে হয়ে যায়। অন্যন্য দেশে এসব সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ ও সংহত একটি আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে।

১৯৮৭ সালে সরকার আইন করে বাংলাদেশে যত আইন হবে, সবই হতে হবে বাংলা ভাষায়। ১৯৮৪ সালের ওই আইনটি ১৯৮৭ সালে এসে বাংলা করার একটি প্রক্রিয়া সামনে আসে। ১৯৯০ সালের পর যখন আমাদের অর্থনীতি একটু বড় হতে থাকে, তখন এ দাবিটি অনেক জোরালো হয় একটি নতুন ও পরিপূর্ণ আয়কর আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু বরাবরের মতোই একটি সমস্যা সামনে এলো। সেটি হলো, আইনটিকে যুগোপযোগীকরণের কাজ কেন আইন কমিশনের কাছে না দিয়ে এনবিআরের কাছে ছিল। আইনটির প্রয়োগকারী এনবিআরকেই আইনটির খসড়া করতে সমস্যা হয়। এই খসড়া তৈরি করতে দেরি হতে থাকে। গত তিন বছর এনবিআর নিজস্ব মেধা ও জোর নেতৃত্ব দিয়ে আইনটি প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করে। এই দৃঢ়তা ছিল দীর্ঘদিনের দাবি।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এটি একটি আইন এবং তা সবার জন্য প্রযোজ্য। আইন যে রকমই করা হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারের এটি দেখতে হবে তা কতটুকু প্রজাবান্ধব নয় জনবান্ধব করা যায়, কতটুকু সহজ করা যায়। সংসদ এটি ভালো করে পরীক্ষা করে পাস করলে এর গ্রহণ ও প্রয়োগযোগ্যতা বৃদ্ধি পেত। না দেখে পাস করা হলে সব দায়দায়িত্ব আইনপ্রণেতাদের ওপর চলে যায়।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *