মোবাইলে বিয়ে, স্বামীকে দেখার আগেই বিধবা মরিয়ম

Slider বিচিত্র


সাত বছর আগে প্রবাসে পাড়ি জমান রুবেল হোসাইন। গত ৯ মাস আগে মোবাইল ফোনে বিয়ে করেন মরিয়ম আক্তারকে। বিয়ের পর রুবেল দেশে ফেরার সুযোগ পাননি। ফোনেই নিয়মিত যোগাযোগ হতো তাদের।

এদিকে, বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন মরিয়ম। তবে হঠাৎ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মরিয়ম খবর পান সৌদি আরবে ফার্নিচারের কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন রুবেল। স্বামীর মৃত্যু সংবাদে থামছেই না মরিয়মের আহাজারি। বিলাপ করছেন স্বামীর জন্য। বিয়ের পর ফুলসজ্জার আগেই বিধবা হলেন তিনি।

রাজশাহীর বাগমারার বারইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুবেল হোসেন। গত সাত বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন তিনি। পাশের বারিহাটি গ্রামে বাড়ি মরিয়ম আক্তারের। মরিয়ম এখন কলেজছাত্রী।

গত শনিবার সন্ধ্যায় সরজমিনে রুবেল হোসাইনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মরিয়ম আক্তার মোবাইল ফোনে স্বামীর ছবি দেখে কাঁদছেন। কান্না কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে একটাবার হলেও দেখতে চাইরে। স্বামীকে আমি কাছ থেকে দেখিনি। আপনাদের পায়ে ধরি, আমার স্বামীকে একনা এনে দেন ভাই। স্বামীকে কোনো দিন চোখের কাছ থেকে দেখিনি। যা দেখেছি দূরে থ্যাকা দেখেছি। যত কথা কছে দূরে থ্যাকাই কথা কছে।’

মরিয়ম আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেনো তুই শুক্রবারের নামাজ পড়লি নারে রুবেল। নামাজ পড়তে গেলে তোকে আর পুড়ে মরতে হতো না।’

মরিয়ম আরও বলেন, ‘সে আমাকে অনেক ভালবাসত। কাজের ফাঁকে যখনই সময় পেত আমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলত। আমি রাগারাগি করতাম, বারবার ওকে দেশে আসতে বলতাম। ও আমাকে খালি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাত। বলত একটু ধৈর্য ধর। দূরে থেকে শুধুই সান্ত্বনা দিত।’

মোবাইলে স্বামীর ছবি দেখে কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম আরও বলেন, ‘আমার রুবেল বড় বড় চুল রাখত। ঈদের আগে আমি বলায় চুল কাটে সে। তাকে তার বোন বলেছিল মায়ের কথায় চুল কাটিসনি, বউয়ের কথায় চুল কাটলু। এই গেঞ্জি পড়ে আমার রুবেল মারা গেছে রে।’

মরিয়ম জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় তাদের শেষ কথা হয়। দেশে আসার জন্য গত শুক্রবার কাগজপত্র জমা দিয়ে কারখানায় যাবেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছিল রুবেল। শুক্রবার রাতে আবার কথা বলবে বলেছিল। রাতে কলও দিয়েছিল মরিয়ম। কিন্তু ফোন বাজলেও কেউ রিসিভ করেনি। রাত নয়টা পর্যন্ত ফোন বেজেছে। এরপর ফোন আর বাজেনি। গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় রুবেলের প্রবাসী বড় ভাই ফোন করে জানায় রুবেল মারা গেছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে রুবেল সবার ছোট।

ছেলে হারানোর বিষয়টি মানতে পারছেন না নিহত রুবেল হোসেনের বাবা জফির উদ্দিন। তিনি জানান, ৭ বছর আগে ঋণ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হয়। কয়েক মাস আগে মোবাইল ফোনে পাশের বারিহাটি গ্রামের মরিয়ম আক্তারের সঙ্গে রুবেলের বিয়ে হয়। স্ত্রীর সঙ্গে তার দেখাও হয়নি। কীভাবে মানব এই মৃত্যু।

সৌদি আরবে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া রাজশাহীর সেই চার শ্রমিক হলেন- বাগমারা উপজেলার ঝিকড়া ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, যোগীপাড়া ইউনিয়নের বড় মাধাইমুরি কাতিলা গ্রামের ফিরুজ আলী সরদার ও বারইপাড়া গ্রামের রুবেল হোসেন এবং একই গ্রামের মো. আরিফ।

নিহত ফিরুজ আলী সরদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনেরা বিলাপ করছেন। ফিরুজের বাবা আনিসুর রহমান সরদারও কাঁদছেন। ফিরুজের স্ত্রী হোসনে আরা এবং তার ৭ ও ৪ বছর বয়সী দুই ছেলেকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার তো এখন আর চাওয়ার কিছু নাই। শুধু মরদেহটা চাই।’

এ বিষয়ে বাগমারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত চলতি দায়িত্ব) সুমন চৌধুরী বলেন, ‘জেলা প্রশাসক বাগমারায় এসে পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদেরকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। এছাড়া মরদেহ আনার জন্য ফরম পূরণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। সে কাজটি আমরা দ্রুতার সঙ্গে করছি। এ ক্ষেত্রে যত সহযোগিতা দেওয়ার প্রয়োজন আমরা দেব।’

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করা হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সৌদি আরবের দাম্মামে ফার্নিচারের কারখানায় আগুনে ৯ বাংলাদেশি নিহত হন। এরমধ্যে চারজনের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়। তাদের মরদেহ এখনো আসেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *