মাছ-মাংসের চড়া বাজারে তরিতরকারিতেই বেশি নির্ভরশীল সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু স্বস্তি নেই সবজির বাজারে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় চাপে থাকা দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এখন সস্তার আলুও। ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ, আদা, চিনি, কাঁচামরিচের পর এবার আলুতেও থাবা বসিয়েছে সিন্ডিকেট। কৃষকের হাতে আলু ফুরাতেই পণ্যটির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। অথচ এবার চাহিদার চেয়ে দেশে প্রায় ২২ লাখ টন বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকায় কেনা আলু এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। সরকারি তথ্যেই উঠে এসেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দরকারি এ পণ্যটির দাম কৃত্রিমভাবে বেড়েছে।
বরাবরের মতোই ব্যবসায়ীরা দায় এড়াতে একে ওপরকে দোষারোপ করছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের হাতে ফুরিয়ে যাওয়ায় আলু এখন বাজারে সরবরাহ হচ্ছে হিমাগারগুলো থেকে। কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে করা হচ্ছে না। সরবরাহ কমিয়ে মজুদদাররা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। হিমাগার, মজুদদার ও পাইকারদের এই ভেলকিবাজিতেই দাম লাফিয়ে বাড়ছে। ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া আলু রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। অল্প সময়ের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধিতে বেশ চাপে রয়েছে খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী।
কদমতলী এলাকার বাসিন্দা রিকশাচলক মো. রুবেল হোসেন বলেন, ‘আগে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কম দামে আলুর তরকারি বা ভর্তা খাইয়া খরচ বাচাইছি। এহন সস্তার আলুও দামি জিনিস। হিসাব কইরা কিনতে হয়। আলুর দাম এহন প্রায় চাউলের দামের সমান হইয়া গেছে।’
বাজারে বেশি দামে বিক্রি হলেও এতে কৃষকরা লাভবান হননি। অথচ অল্প সময়ে বিপুল মুনাফা করছে অসাধু চক্র। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনেও কারসাজির তথ্য উঠে এসেছে। আলুর অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করে অধিদপ্তর কৃষি মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া আলু এখন বাজারে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আরও বলা হয়, এবারে আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ দশমিক ৫০ টাকা, যেটা সব খরচ মিলে খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কৃত্রিমভাবে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করছে। এর জন্য অবশ্য হিমাগার মালিকদেরও দায়ী করা হয়েছে। কারণ হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছে না।
জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দেশের আলু উঠতে শুরু করে। আলুর একটা অংশ কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি বাজারে আসে, কৃষকের কাছে কিছু মজুদ থাকে এবং বাকিটা থাকে হিমাগারে। ৩৬৫টি হিমাগারে এ বছর ২৪ দশমিক ৯২ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এ সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে হিমাগার থেকে ২ দশমিক ৬৯ লাখ টন খাবার আলু খালাস হয়েছে। আর ৮৯ দশমিক ১৯ শতাংশ আলু এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। তবে কৃষকের ঘরে এখন আর কোনো আলু সংরক্ষণ করা নেই।
অধিদপ্তরটি বলছে, এ বছর চাহিদার বিপরীতে ২১ দশমিক ৯৯ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও গত প্রায় ১৫ দিন ধরে আলুর দাম বাড়ছে। সর্বশেষ ১০ জুলাই পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩৩ টাকা। অথচ পাইকারি পর্যায়ে এ আলু ২৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
বিভিন্ন পণ্যে কারসাজি করেও বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় গলদ রয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন পণ্যে অল্প সময়ে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু চক্র।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, এর আগে পেঁয়াজ, সয়াবিন, ডিম, মুরগিতে দেখেছি, এরপর চিনিতে এবং সম্প্রতি কাঁচামরিচেও কারসাজি দেখেছি। এখন আলুতেও কারসাজি চলছে। বারবার সিন্ডিকেটের বিষয়টি আলোচনায় আসছে। অনুসন্ধানে কারসাজিকারীদের নামও উঠে আসছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। আমাদের আইন আছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ দেখছি না। যদিও মাঝে মাঝে হাতেগোনা কয়েকজনকে জরিমানা করা হয় কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। অপরাধ করেও বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় অতি মুনাফা করার প্রবণতাটা এখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। এতে ভোক্তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, আলুর উৎপাদন ও সংরক্ষণের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক নয়। অপরদিকে আলুর দাম হিমাগারে নয় বরং হাত বদলে বাড়ছে বলে তাদের দাবি।
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আমাদের সময়কে বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে এবার দেশে ১ কোটি ১১ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। আমরা এর সঙ্গে একমত নই। আমাদের মতে, এটা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টনের বেশি হওয়ার কথা নয়। অপরদিকে অধিদপ্তর বলছে, এ বছর হিমাগারে ২৪ দশমিক ৯২ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের হিসাব অনুযায়ী এটা ২৩ দশমিক ১২ লাখ টন।
মোস্তফা আজাদ আরও বলেন, আলুর দাম হিমাগারে বাড়ছে না। হিমাগার থেকে আলু বের হওয়ার সময় হিমাগারের খরচবাবদ দাম ১৭ থেকে ১৮ টাকার বেশি না। এরপর আরও খরচ রয়েছে তা মিলিয়ে হিমাগার শেডে প্রতিকেজি আলু ৩০ থেকে ৩২ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এরপর এই আলু তিন হাত বদল হয়ে খুচরা বাজারে পৌঁছায়। এই হাত বদলে দাম অতিরিক্ত বাড়ছে।