মেরুদণ্ডধারী তাবৎ প্রাণি, জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে মানুষ ছাড়া কেউই দণ্ডধারী নয়। অর্থাৎ তারা হাতে, পায়ে বা মুখে কোন অস্ত্র বা দণ্ড ধারণ করতে পারে না। তারা রাজনীতির মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করতে পারে না। শাসক শ্রেণীতে আসীন হতে পারে না। দণ্ড ধারণ করে প্রাণীদের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপে আধিপত্য বিস্তার করে নিজের প্রভাব বলয় সম্প্রসারিত করা একমাত্র মানুষের দ্বারাই সম্ভব। কিছু কিছু পশু-পাখিরও সীমানার জোর বা খুঁটির জোর থাকে। তবে সেক্ষেত্রে তাকে নিজের শরীরের অংশ যেমন- ধারালো দাঁত, নখ, ঠোঁট, পা, শিং, খুর, মাথা, পা, শরীর নিসৃত বিষ, ধারালো লেজ, শুঁড় ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। অন্যপক্ষে মানুষ সরাসরি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আঘাত করার পাশাপাশি অন্য কোন অস্ত্র ধারণ করে অপরকে ভীত-সন্ত্রস্ত, ঘায়েল করতে পারে, শাসন করতে পারে কিংবা হত্যা করতে পারে। আবার মানুষই পারে একেবারেই কোন অস্ত্রের উপর হাত না রেখে কেবল হুকুম বা ইশারার মাধ্যমে অন্য কোন এক বা একাধিক কিংবা বহুসংখ্যক মানুষকে দণ্ডধারণ করিয়ে, ত্রাসের সঞ্চার করে কোন বিশাল জনগোষ্ঠীকে পরিচালনা, শাসন কিংবা শোষণ করতে। এই কারণে মনুষ্য জাতিকে বলা হয় প্রাণিকূল শিরোমণি।
এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে। আরো রয়েছে তার বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। অন্য কয়েকটি প্রাণীও মাঝে-মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদেরকেও স্তর অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তবে তা মানুষের মতো পরিকল্পিত, সমন্বিত, দূরদর্শী, সুদূরপ্রসারী ও পরিশীলিত নয়। মানুষের মতো বিশাল প্রেক্ষাপটে, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন অন্য প্রাণীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, বিবেক, বুদ্ধি, নীতিবোধ ইত্যাদির অভাবেই পশু-পাখিরা ইতর শ্রেণীর অভিধাপ্রাপ্ত প্রাণী।
মানুষের মধ্যে শুধু দণ্ডধারণের ক্ষমতা থাকলেই চলবে না। তার মাঝে থাকতে হবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। দণ্ড এবং মেরুদণ্ডের ভূমিকা এক নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে দণ্ডধারী শাসক ও দণ্ডশাসিত মানুষ- এর কোনটিই কাম্য নয়। যদিও ইদানীং অনেকেই আক্ষেপ করে বলে থাকেন, আমরা সামরিক শাসনের উপযোগী এবং সেনাশাসন ছাড়া আমাদের চরিত্র ঠিক করা যাবে না। আমাদের স্মরণে থাকা দরকার, দণ্ডধারী ও দণ্ডশাসিত জনগোষ্ঠীর কোন আত্মমর্যাদা থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসভ্য, অশালীন, বর্বর মানুষদের মধ্যেই কারণে-অকারণে দণ্ডের ব্যবহার লক্ষণীয়।
কেবল সামরিক দণ্ডধারীরাই নয়, কোন কোন দেশে বেসামরিক শাসকরাও জনগণের বিরুদ্ধে দণ্ড ধারণ করে থাকে। দণ্ড প্রয়োগের তাত্ক্ষণিক সুফল ও কার্যকারিতা তাদেরকে এপথে এগিয়ে যেতে উত্সাহ যোগায়। প্রথম অবস্থায় জনগণ দণ্ডাঘাতে রক্তাক্ত, জর্জরিত হতে হতে পশ্চাত্পসরণ করতে থাকে। তারপর পিঠে দেয়াল ঠেকে যাবার পর প্রতিবাদী হয়ে প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের পথে এগিয়ে যায়। তবে কোনকালেই কোন দণ্ডধারী শাসক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। একটা সময়ে তাদের সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা কমে যায়। তারা নিজেদেরকে একটি নব্যশ্রেণী বা গোষ্ঠী হিসাবে ভাবতে শুরু করে। ততদিনে জনগণ তাদেরকে চিনে ফেলে। বেশভুষা, খাদ্য, সম্পদ ও জীবনযাত্রার মানদণ্ডে তারা সাধারণ মানুষ থেকে ক্রমশ আলাদা হয়ে যায়। স্বার্থপর, সুযোগ সন্ধানী চাটুকারের দল তাদের আবেষ্টন করে রাখে। একদিন জনতার জাগরণে, গণমানুষের উত্থিত দণ্ডের সামনে শাসকের দণ্ড খসে পড়ে স্খলিত হয়। অবহেলিত, উপেক্ষিত মানুষের উত্তাল জোয়ারে পরিস্থিতি ওলট-পালট হয়ে যায়। থেমে যায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালীর দণ্ডের আস্ফাালন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ১৯৫৮ সালের ০৭ অক্টোবর দণ্ডশাসনের সূত্রপাত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। মাত্র ২ বছরের মধ্যে পরপর ৪ জন প্রধানমন্ত্রী (চৌধুরী মোহাম্মাদ আলী, হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় এবং স্যার ফিরেজ খান নুন) রদবদলের পর পাকিস্তানের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান স্থগিত করে জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ করেন। এর মাত্র ০৩ সপ্তাহ পরেই ২৭ অক্টোবর তারিখে ইস্কান্দার মির্জাকে বহিষ্কার করে আইয়ুব খান নিজেই প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করে সামরিক শাসনের ক্ষেত্র প্রসারিত করেন। এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানীরা সামরিক দণ্ডধারীদের অধীন হলো। সাড়ে তিন বছর সামরিক শাসন চালানোর পর আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের মে মাসে সামরিক শাসনের পরিবর্তে বেসামরিক লেবাসে তার কর্তৃত্ব বহাল ও সংহত করার জন্য জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন।
সময়ের বাস্তবতায় এক দশকের মধ্যেই আইয়ুব খান বুঝতে সক্ষম হলেন মৌলিক গণতন্ত্রের লেবাসে পাকিস্তানে দণ্ডের শাসন বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণ-আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করে আইয়ুব খান ২৫ মার্চ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ফলে আমরা আবারও সামরিক দণ্ডধারীদের অধীনে চলে গেলাম। গণদাবির চাপে ইয়াহিয়া খান এককেন্দ্রিক শাসন পদ্ধতি বাতিল করে এক ব্যক্তির এক ভোট নীতিতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন। ১৯৫৮ থেকে ৬৯ পরিসরে দণ্ডধারীদের আঘাতের ভেতর দিয়েই ১৯৭০সালে এ দেশবাসী মেরুদণ্ড সোজা করে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল আমরা সমান অধিকার চাই। আমরা সোজা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু নির্বাচনের রায় অনুযায়ী আমাদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হলো না। সেই ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনকে বুকে ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যে জেগে উঠেছিল তা তখনো শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৫২ সালের দণ্ডাঘাতে মেরুদণ্ডে এবং বারুদের আঘাতে বুকের মাঝে শাসকরা যে ক্ষতের সূচনা করেছিল তার চিহ্ন তখনো মুছে যায়নি। অধিকার, হিসাব এবং জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর হিংস হায়েনার মতো। ভেঙ্গে দিতে চাইলো আমাদের মেরুদণ্ড যাতে আমরা আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারি। বাছাই করে হত্যা করা হলো আমাদের সেরা সন্তানদের। না, তাদের দুরাশা বাস্তবায়িত হলো না। সহসাই জেগে উঠলাম আমরা। বাধ্য হয়ে আমরা দণ্ড তুলে নিলাম হাতে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বর্বর দখলদারের হাত থেকে দণ্ড খসে পড়লো। যবনিকাপাত হলো লাঠিয়াল শাসনের। হলো অস্ত্র সমর্পণ। হলো আত্মসমর্পণ। আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে নয়, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম। তারপর আমরা নিজেরাই হয়ে গেলাম দণ্ডধারী। অপার সম্ভাবনা দেখা দিল জাতীয় ঐকমত্যের। থাকবে না বিভেদ মানুষে মানুষে। পার্থক্য থাকবে না শাসকে-শাসিতে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হলাম। স্বাধীনভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ এসে গেল আমাদের সামনে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের প্রত্যাশা ছিল তাদেরকে আর দণ্ডাঘাতের সম্মুখীন হতে হবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই চালিত হবে দেশের শাসন। মানুষ পাবে উপযুক্ত মর্যাদা, সম্মান ও ন্যায় বিচার। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে আমরা কয়েকবার পতিত হলাম দণ্ড শাসনের অধীনে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে তত্কালীন সামরিক দণ্ডধর তদীয় শাসনকালের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, জাতীয় সংসদে জায়েজ করে নিয়ে যখন গণতন্ত্রের বাহনে সওয়ার হলেন তখন জাতি সামরিক দণ্ডকারণ্য থেকে বেরিয়ে বেসামরিক দণ্ডের বলয়ে প্রবেশ করে। শেষ পর্যন্ত চার বছর পর জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে ১৯৯০ সালের ০৬ ডিসেম্বর জাতি একটি বেসামরিক দণ্ডশাসনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্রের অপরিসর অববাহিকায় হাঁটতে শুরু করে।
তারপর গণতন্ত্রের আকাশে আবারও অশনিসংকেত। ক্ষমতার রশি টানাটানিতে আমরা সমানে সমান পারদর্শিতা প্রমাণ করে কেয়ারটেকারের ছদ্মাবরণে একটি আধা-সামরিক দণ্ডব্যুহে প্রবেশ করি। সেখানে চলে যোগ-বিয়োগের নানান মেলা এবং কারাদণ্ডের হোলিখেলা ।
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ সরকারগুলো ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদেরকে শাসক কিংবা প্রভুগোত্রীয় ভাবতে থাকে। তখন জনগণের বিরাট একটা অংশকে তারা অবহেলা করে। নিজেদের ক্ষমতার প্রতি হুমকি বিবেচনা করে কিছু মানুষের উপর তারা দণ্ড চালাতেও দ্বিধা করে না। এটি নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের একটি বিকৃত রূপ। কখনো কখনো সংখ্যালঘুর উপর চলে সংখ্যাগুরুর অবদমন। সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে যারা সরকার গঠন করে তারা শুধু তাদের তথাকথিত সমর্থকদের মাঝেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। সংখ্যালঘুরা হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সবক’টি সেক্টরে নিজেদের সমর্থকদের অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলে। তাদের লক্ষ্য থাকে পরবর্তী আরেকটি নির্বাচনে আবার জয়ী হয়ে আসার। এসকল কারণে বর্তমানে কোন কোন দেশের গণতন্ত্রকে আর ইব্রাহাম লিঙ্কনীয় সংজ্ঞায় অক্ষত রাখা যাচ্ছে না।
তাই কিছু কিছু দেশে কৈশোর উত্তীর্ণ হবার আগেই গণতন্ত্র বারবার চরিত্র হারাচ্ছে। বলবান দণ্ডধারীরা সুযোগ পেলেই গণতন্ত্রের উপর চড়াও হচ্ছে এবং টেনে-হিঁচড়ে সব লুটে নিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র তখন নির্জন মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ধ্বজাধারীদের উদ্দেশ্যে দু’হাত তুলে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। পেশী সবল দুর্বৃত্তদের দাপটে এবং দণ্ডাঘাতে সমাজচ্যুত গণতন্ত্র এবং সাধারণ মানুষ বার বার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সরকারের অধীনে কাতরাতে থাকে। মেরুদণ্ডহীন জনসাধারণ তখন অন্য কারো সাহায্য কামনা করে। অনেকেই সুযোগ বুঝে ভক্ষকের অন্তরালে রক্ষক সেজে এগিয়ে আসে ফায়দা লোটার জন্যে। একসময়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। কখনো রাজনৈতিক কাল বৈশাখী এসে হঠাত্ সব ওলট-পালট, ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। সাধারণ জনগণ তখন জেগে ওঠে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দণ্ডধারীর সাজানো দাবার ছক। মেঘমুক্ত প্রহরে শুভ্রবাসনা গণতন্ত্র আবার এগিয়ে আসে ধীরলয়ে। সতেজ-সবুজ হয়ে ওঠে প্রকৃতি। তখন মানুষ আলোর প্রত্যাশায় সম্মুখে তাকায়। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁডায়। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে আমরা সত্যিকার মেরুদণ্ডধারী মানুষ চাই। গণতন্ত্রের সহায়ক, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সরকার চাই। দণ্ডধারী সরকার নয়। আমরা চাই শক্ত মেরুদণ্ডের সরকার। কারণ তারাই স্বাধীন জাতিকে মেরুদণ্ডের উপর দাঁড় করাতে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা (লেখাটি ইত্তেফাকের দৃষ্টিকোন পাতায় ছাপা হয়েছে। যার লিংক নিচে দেয়া হলো)