রাজধানীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ও জোটগুলোর চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের ঘোষণা হতে যাচ্ছে আজ। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের এই এক দফা দাবি যুগপৎভাবে ঘোষণা করবে দলগুলো। একই সাথে ঘোষণা করা হবে ‘রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা’ রূপরেখা ও আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি। বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেলা ২টায় বিশাল সমাবেশ করে এক দফা ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, আজকের সমাবেশ হবে নজিরবিহীন ও সর্ববৃহৎ।
জানা গেছে, আগামী শুক্রবার বা শনিবার ঢাকাজুড়ে মানববন্ধন অথবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এক দফার আন্দোলনের সূচনা হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, এক দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতি আশান্বিত হবে, উজ্জীবিত হবে। আন্দোলন আরো শক্তিশালী-বেগবান হয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কী থাকছে এক দফায় : সরকারের পদত্যাগই এক দফার মূল বিষয়। তবে এর সাথে আরো কয়েকটি দাবিও থাকছে। এক দফার শিরোনাম করা হয়েছে- ‘যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের ১ দফার যৌথ ঘোষণা’। এখানে থাকছে- বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা; বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করা।
বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, এক দফার আন্দোলনের যাত্রাকে রাজনৈতিকভাবে অর্থপূর্ণ করতে আজকের সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, ঢাকা মহানগর, জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের সাথে প্রস্তুতি সভা করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এ ছাড়া বিগত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা বিভাগের অধীন প্রতিটি সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রথম দু’জন প্রার্থীকে নিয়েও প্রস্তুতি সভা করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। এসব সভায় ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জনসমাগম বাড়াতে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান সমাবেশ প্রসঙ্গে বলেন, সমাবেশ হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। এ জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা আশা করছি, এই সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেবে। ঢাকার জনগণ রাজপথে তাদের দাবি নিয়ে নেমে আসবে। সমাবেশ থেকে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা বাস্তবায়ন হলে জনগণ ভোটাধিকার ফিরে পাবে।
কে কোথায় এক দফা ঘোষণা করবে : গণতন্ত্র মঞ্চ বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্ল¬াবে সংবাদ সম্মেলন করে অভিন্ন এক দফা, নতুন কর্মসূচি ও রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করবে। এ ছাড়া ১২ দলীয় জোট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিজয়নগর পানির ট্যাংকি-সংলগ্ন আলরাজী কমপ্লেক্সের সামনে, এলডিপি তেজগাঁওয়ে এফডিসি-সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ে, গণফোরাম-বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) আরামবাগে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে, এনডিপি বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে, লেবার পার্টি নয়াপল্টনে মসজিদ গলিতে দলীয় কার্যালয়ে, গণ অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) জাতীয় প্রেস ক্লাবে, গণ অধিকার পরিষদ (নুরুল হক নুর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবং গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, সমমনা গণতান্ত্রিক পেশাজীবী জোট ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জাতীয় প্রেস ক্লাবে বেলা ৩টায় এই ঘোষণা দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকের আগে বড় জমায়েতের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে এই সমাবেশ সম্পন্ন করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর নজর রাখা আন্তর্জাতিক মহলকে বিশেষ ‘বার্তা’ দিতে চায় দলটি। সেটি হলো- সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করা। তাই এক দফার সমাবেশ থেকে শান্তিপূর্ণ সিরিজ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ৩৬টি বিরোধী দল একযোগে এক দফার ঘোষণা দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর সাড়া পড়বে। আর এর মধ্য দিয়ে তারা যে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে, সে বার্তাও দিতে চায় দলটি।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের মধ্য দিয়ে মাঠে গড়ায় তাদের আন্দোলন। এখন পর্যন্ত গণমিছিল, গণ-অবস্থান, মিছিল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
কী কর্মসূচি আসতে পারে : অহিংস পথেই চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা করতে চাইছে বিএনপি। সে কারণে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যেতে চায় না দলটি। জানা গেছে, এক দফা আন্দোলনের মূল ফোকাস হবে ঢাকা। তাই এক দফার সমাবেশ থেকে ঢাকাকে ঘিরে সিরিজ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হতে পারে। আর আগামী শুক্রবার বা শনিবার ঢাকাজুড়ে মানববন্ধন বা মানবপ্রাচীর অথবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এক দফার আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। এরপর পর্যায়ক্রমে পদযাত্রা, সমাবেশ, বিক্ষোভ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতে জনগণকে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করাই বিএনপির লক্ষ্য। আর আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘেরাওসহ ঢাকায় লাগাতার অবস্থানের কর্মসূচি আসতে পারে। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশে গণ-অভ্যুত্থান পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দাবি আদায় করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, বিএনপির এই মুহূর্তে ঘোষিত কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জুলাই খুলনায় ও ২২ জুলাই ঢাকায় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ রয়েছে। জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল এই সমাবেশ করছে। এ ছাড়া ১৪ জুলাই নোয়াখালীতে পদযাত্রা করবে কৃষক দল, শ্রমিক দল, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল ও জাসাস। নোয়াখালীর পর ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম, ১৯ জুলাই দিনাজপুর, ২৮ জুলাই রাজশাহী, ৫ আগস্ট যশোর, ১২ আগস্ট হবিগঞ্জ ও ১৯ আগস্ট বরিশালে পদযাত্রা হবে। এসব কর্মসূচির সাথে এক দফা আন্দোলনও চলবে। এ ছাড়া আগামী ১৯-২১ জুলাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করবে গণতন্ত্র মঞ্চ।