গ্রাম বাংলা ডেস্ক: বার্সেলোনা ছাড়া অন্যত্র খেলেননি মেসি। ক্লাবের হয়ে ২৭৬ ম্যাচে ২৪৩ গোল, জাতীয় দলের হয়ে ৮৩ ম্যাচে ৩৭ গোল, ২০১০ থেকে টানা তিনবার ব্যালন ডি অর পুরস্কার লাভ, ২০০৯ থেকে টানা তিন বার লা লিগার বর্ষসেরা ফুটবলার, এক বছরে সর্বাধিক গোলের (৯১) রেকর্ড নিয়ে একজন লিওনেল মেসি তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত। সেটি কোন মুহূর্ত? লন্ডন টেলিগ্রাফের চিফ স্পোর্টস রিপোর্টার পল হেওয়ার্ডের কথায়, লিওনেল মেসি রেডি ফর হিজ ম্যারাডোনা মোমেন্ট। ‘১৩ই জুলাইয়ে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ যে হবে তার উপরে দেখা যাবে দুই জাতির লড়াই। আর আসলে আকর্ষণীয় ফয়সালা, যেটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক বড় সত্যি তা হলো, মেসি কি ম্যারাডোনা হতে পারবেন? কোন সে বর্ণিল রূপকথাতুল্য মুহূর্ত যখন মেসি, লোকান্তরিত না হয়েই, এই মর্ত্যের লোকালয়ে কোটি কোটি মানুষের আবেগে, পুলকে, আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হতে হতে রূপান্তরিত হবেন ম্যারাডোনায়।
দুনিয়া কাঁপানো বিতর্কটা প্রথম শুরু করেছিলেন ’৭৮-এ আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী কোচ লুই সিজার মেনোত্তি। ম্যারাডোনা আর মেসি নিয়ে বছর কয়েক আগে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মেসি, ম্যারাডোনা দু’জনই আর্জেন্টিনার ফুটবল-গর্ব। কিন্তু সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে আমি কিন্তু মেসির চেয়ে দিয়েগোকেই এগিয়ে রাখবো।”
এই মন্তব্যের পরেই পাল্টা মুখ খোলেন ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার দুই প্রথম সারির ফুটবল ব্যক্তিত্ব। এদের প্রথম জন টোস্টাও। যিনি ’৭০-এর বিশ্বকাপ জয়ী পেলেদের ব্রাজিল টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার কথায়, “ম্যারাডোনার চেয়ে মেসির খেলা অনেক আকর্ষণীয়। চোখকে সুখী করতে হলে আমি মেসির খেলাই দেখতে বসবো।” আর্জেন্টাইন কোচ কার্লোস বিয়াঞ্চি আবার দুই ‘এম’কেই বেড়ে উঠতে দেখেছেন। সেই বিয়াঞ্চি বলে বসেন, ‘পেলে বা ম্যারাডোনার চেয়েও মেসি এগিয়ে।’
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার এই তিন ফুটবল নক্ষত্রের মন্তব্য একটা কথাই প্রমাণ করে আর্জেন্টিনার দুই অধিনায়কের খেলায় প্রচুর মিল। দু’জনই দশে দশ। অমিলও রয়েছে বেশ কিছু। সে কারণেই এই দুই ফুটবল গ্রেটকে নিয়ে এত তুলনা।
’৮৬-র বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল। হেক্টর এনরিকের থেকে নিজেদের অর্ধে সেন্টার সার্কেলের ১০ মিটার ভিতরে বলটা পেল ম্যারাডোনা। তার পরের দশ সেকেন্ডে ইংরেজদের গোলের দিকে ম্যারাডোনার ৬০ মিটারের দৌড়। আর সেই দৌড়ে ধাপে ধাপে ফুটবলের রাজপুত্র ড্রিবল করে ছিটকে দিল পিটার বিয়ার্ডসলি, পিটার রিড, টেরি বুচার (দু’বার) এবং টেরি ফেনউইক। সবশেষে ইংল্যান্ড গোলকিপার পিটার শিল্টনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনার সেই ঐতিহাসিক গোল। এবারের বিশ্বকাপে মেসির হয়েছে কি তার ম্যাজিকটা ঠিক ঝলসে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যাচ্ছে। কারও মনটাই ঠিক পুরোপুরি ভরিয়ে দেয়াটা বাকি। কমলাদের সঙ্গে শেষ লড়াইয়েও মেসির যেন কোথায় একটা খামতি থেকে গেল। যদিও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার বিরুদ্ধে তিন জনকে ড্রিবল করে তার গোল সেই উত্তর দিয়ে দেবে। বছর সাতেক আগে স্প্যানিশ লীগে গেটাফের বিরুদ্ধে লিও মেসির গোলটা কারও ভোলার নয়। সেই ম্যাচে তিনি ম্যারাডোনার মতোই ছ’জনকে ড্রিবল করতে করতে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে গোলটা দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এমন একটা গোলের চাওয়া জার্মানদের বিরুদ্ধেই।
মেসি ও মারাদোনা দু’জনেই এরিয়াল বলে হেড দিয়ে গোল করায় সে রকম দক্ষ নন। দু’জনেরই উচ্চতা কম। দু’জনেই বল পেলে মনে হয় ওদের পায়ে বল লেপ্টে থাকে। যদি উচ্চতা বেশি হতো তা হলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই কোয়ার্টার ফাইনালে তো শিল্টনকে টপকে হেডেই প্রথম গোলটা করতে পারতেন ম্যারাডোনা। তাহলে তাকে আর ‘বিধাতার হাত’ বিতর্ক তাড়া করতো না।
এবারের বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে সুইসদের বিরুদ্ধে ডি’মারিয়ার গোলটা মেসিরই। ওর জন্য যে ফরোয়ার্ড পাসটা রাখলেন মেসি, সেখান থেকে গোল করতে ভুল করেনি ডি’মারিয়া। ’৮৬-র বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনা তা-ই করেছিলেন। মেক্সিকোর আজটেক স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা-পশ্চিম জার্মানি ম্যাচ। ব্রাউন আর ভালদানোর গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে যাওয়ার পর তা শোধ করে দেয় রুমেনিগে, ফোলার। ম্যারাডোনা খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আগে জয়সূচক গোলটা বুরুচাগাকে দিয়ে করানোর সময় বলটা কিন্তু বাড়িয়েছিলেন তার দিকে না তাকিয়েই। দু’জনের এই ড্রিবলিং, ফরোয়ার্ড পাসিং ইত্যাদিতে দারুণ মিল। তবে ওদের মধ্যে অমিলও প্রচুর।
ম্যারাডোনার চেয়ে মেসির মাথা ঠা-া। কোন বিতর্কে নেই। নিপাট ভদ্রলোক। মেসিপত্নী যেভাবে তাদের ফুটফুটে ছেলেটাকে গ্রামবাংলার বউদের মতো কোলে করে মাঠে এনেছেন তাতেও মেসির মাঠের ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। ম্যারাডোনা অনেক সময় আবেগটাকে সংবরণ করতে পারতেন না। মাঝেমাঝেই উত্তেজিত। ’৮২তে স্পেনের বিশ্বকাপে ব্রাজিল ম্যাচে সক্রেটিস ওকে প্রায় বোতলবন্দি করে রেখেছিলেন। ম্যারাডোনা সেই রাগে টার্গেট করেছিল ফালকাওকে। কিন্তু ওকে বাগে না পেয়ে মেরে বসেন বাতিস্তাকে। ফল লাল কার্ড। ম্যারাডোনার মার্চিং অর্ডার। সেখানে মেসির মাথাটা শসার মতো ঠা-া। কেউ মারলে তেড়ে যান না। উল্টো শিশুসুলভ হাসিমুখে তাকিয়ে থাকেন সেই ফুটবলারের দিকে। মাঠে কখন কি করবেন, কতটা ড্রিবল, কতটা দৌড়, মাঠের বাইরে কতটা কথা বলবেন- সবটাতেই মেসি সংযম।
তবে কোটি টাকা দামের কথা হলো, ম্যারাডোনার হাতে লেপ্টে রয়েছে ’৮৬-র বিশ্বকাপ। এখনও তিনিই আর্জেন্টিনার দেবতা। তার স্থান এখনও হিমালয়ের মতোই অটল। ৭-১ গোল দেখে দিয়াগো দুহিতা পিতাকে টুইট সেমিতে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি চারটা গোল হজম করতে পারতে? তিনটে বিশ্বকাপ খেলে একটায় চ্যাম্পিয়ন। নব্বইতে রানার্স। সাফল্যের দিক দিয়ে তাই এখন পর্যন্ত এগিয়ে কিন্তু সেই দিয়াগোই। যদিও ম্যারাডোনা অহর্নিশ মেসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ‘মেসি আমার চেয়েও বড়।’ কিন্তু বিনম্র মেসি জানেন হক কথাটি কি। তাই তার উক্তি: ম্যারাডোনা একা বিশ্বকাপ এনেছেন। আর আমি কোথায়? ওর সঙ্গে তুলনাই চলে না।
সূর্যাস্তের আর কয়েকটি চক্র মাত্র। “সেমিফাইনালে উঠে একটা বড় বাধা পেরিয়েছি বলা যায়। দু’হাজার ছয় আর আট, দু’বারই আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে ছিটকে পড়েছিলাম,” বলেছেন মেসি।
একই সঙ্গে মেসি এ-ও বলেছেন, ‘বড় বাধাটা যখন টপকানো গিয়েছে, তখন আমরা আরও এগোবার আশা এবার করতেই পারি।’ তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আর্জেন্টিনা সমর্থকদের স্বপ্নের খানিকটা অংশীদার তিনি নিজেও! ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্যটা আমরা পূরণ করেছি। এবার আমরা আরও বেশি কিছু চাইছি।
মেসি ফেসবুকে বার্তা লিখেছেন। অবশ্য মাঠ থেকে বেরিয়ে তাকে রুটিন ডোপ টেস্ট টপকাতে হয়েছে। এমনই এক টেস্টে ম্যারাডোনা হোঁচট খেয়ে ভক্তকুলকে বিব্রত করেছিলেন। মেসিতে সে ভয় কারও নেই। ফেসবুকের শব্দমালায় একজন মানবিক মেসি মূর্ত। তিনি লিখেছেন, ‘আমি এই ফুটবল স্কুলের একজন ছাত্র হতে পেরে গর্বিত। যা কিছু ঘটছে তার সবটাই একটি উন্মাদনা। একটি পাগলামি। আমরা ফাইনালে উপনীত হয়েছি। আর মাত্র ছোট একটি পদক্ষেপ।’