আগামী ১২ জুলাই সরকারবিরোধী একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বিএনপি। রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘বিশাল সমাবেশ’ থেকে এ ঘোষণা দেবে দলটি। এ জন্য বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলোকে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের (ভার্চুয়ালি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রায় এক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার সভায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়। নয়াপল্টনের এই বৈঠকের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের ভাড়াবাসা ফিরোজায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পর রাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। মহাসচিব ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে অংশ নেন
বৈঠকসূত্রে জানা যায়, আগামী ১২ জুলাই একই দিনে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থাকবে কিনা, এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। গতকাল রাতে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা আমাদের সময়কে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী কী করবে, সে বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এর পর ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গত ৩০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অংশ নিলেও পরে যুগপৎ কর্মসূচিতে দলটিকে দেখা যায়নি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনবিষয়ক ছয় সদস্যের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সঙ্গে দলটির প্রতিনিধি দলের বৈঠকের কথা রয়েছে। ১৬ দিনের ইইউ মিশনটির দুই সদস্য গতকাল শনিবার ঢাকায় পৌঁছেছে। আজ রবিবার বাকি চার সদস্য পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তাদের সঙ্গে বৈঠকের আগেই সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের কাছে বিএনপি বার্তা দিতে চায়, সরকার পতনের আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে নেমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈঠকের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ১২ জুলাই নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের জমায়েত করে একদফার ভিত্তিতে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করীম রনি আমাদের সময়কে বলেন, ১২ জুলাইয়ের সমাবেশ সফলের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের আছে।
এদিকে, আজ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যৌথসভা আহ্বান করেছে। বেলা ৩টায় নয়াপল্টনের ভাসানী ভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা জেলা বিএনপিও আগামীকাল সোমবার থানা ও পৌর কমিটির বৈঠক আহ্বান করেছে। নির্দেশনা পাওয়ার পর অন্যান্য জেলা ও মহানগর কমিটিও কাজ করছে বলে জানান ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ।
অন্যদিকে, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে আগামীকাল সোমবার মতবিনিময় সভা আহ্বান করেছেন। ঢাকা বিভাগের প্রতিটি জেলা মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সুপার ফাইভ নেতাদের আহ্বান করা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এ জন্য আজ অথবা কালকের মধ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের ডিএমপিতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে তাদের জানানো হয় দলের শীর্ষনেতা তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারুণ্যের সমাবেশে অংশ নিতে ততক্ষণে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা সিলেটে অবস্থান করছিলেন। বৈঠকে অংশ নিতে দ্রুত তারা ঢাকা ফেরেন।
বৈঠকসূত্র জানায়, প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও জেলা ও অঙ্গসংগঠনের একজন করে শীর্ষনেতা বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদও অংশ নেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বলেন, কর্মসূচিতে ব্যাপক লোকসমাগমের প্রস্তুতি নিতে সবার নজর দিতে বলা হয়েছে। ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে যেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব।
এদিকে রাতে স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সমমনা জোট ও দলগুলোর কর্মসূচির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাবে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ ও ঘেরাওসহ লাগাতার নানা কর্মসূচির প্রস্তাব রয়েছে। তবে বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো সহিংসতার কর্মসূচিতে যেতে চায় না। অহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করতে চায়। পরিস্থিতি বাধ্য করতে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে দলটি। কিন্তু ১২ জুলাই কী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গত কয়েকদিনে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দুটি জোট ও দুটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের পাশাপাশি গণফোরাম ও পিপলস পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা। বৈঠকে সব দল সরকার পতনের লক্ষ্যে একদফার ঘোষণায় যেতে একমত হয়। এসব সমমনা দল ও জোট একমঞ্চ থেকে যৌথ ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও আন্দোলনের মূল দল বিএনপি আপাতত পৃথক পৃথক প্ল্যাটফর্ম থেকে একদফার আন্দোলন ঘোষণা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেন, রাজপথের সম্পর্ক ভিত্তি ধরে একমঞ্চে ওঠার পক্ষে বিএনপি। আগামীকাল সোমবার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক আছে। ওই বৈঠকে সম্মিলিত বিরোধী দলের রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনা হবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, চলমান আন্দোলনকে একটি গণআন্দোলন বা জাতীয় রূপ দিতে চাইলে বিরোধী দলগুলোকে একমঞ্চে ওঠার জন্য আরও অপেক্ষা করা হতে পারে। রাজপথ থেকেই সব দলের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই একমঞ্চে উঠলে আন্দোলনে ভালো ফল আসবে বলে মনে করেন এই নেতা।