জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে সাংগঠনিক শক্তি আরও মজবুত করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম বেগবানও করতে চায় দলটি। এ জন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে দেশব্যাপী ছাত্র-যুব সমাবেশ করার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল বুধবার সকালে এক যৌথসভায় তিনি এই পরামর্শ দেন।
দলের ভ্রাতৃপ্রতিম, সহযোগী সংগঠন এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে এ সভা হয়। এ সময় ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন তিনি। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী পক্ষের বক্তব্যের তথ্যনির্ভর জবাব দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ ও শ্রমিক লীগের কোন্দল মেটানোর নির্দেশও দেন তিনি।
রীতি অনুযায়ী সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। এরপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে ওবায়দুল কাদের সভায় উপস্থিত নেতাদের কথা শোনেন। কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও যুব মহিলা লীগের নেতারা কথা বলার সময় তাদের সাংগঠনিক কোন্দলের বিষয়টি উঠে আসে। সভায় অভিযোগ ওঠে, যুব মহিলা লীগের সভাপতি ডেইজি সারোয়ারের স্বাক্ষর নকল করে সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি প্রেস রিলিজ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ডেইজি সুস্থ হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আর কোনো আয়োজন করা যাবে না। সুস্থ হলে একসঙ্গে কর্মসূচি দিতে হবে।’
এ সময় ড. হাছান মাহমুদ লিলির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনি আমার থানায় আমার পরামর্শ ছাড়া যুব মহিলা লীগের সম্মেলন স্থগিত করার নির্দেশনা দেন! এত সাহস কোথায় পান?’ এ সময় সভায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় দুই নেতা বিষয়টি ঠিক হয়নি বলে অভিমত দেন।
কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি অভিযোগ করেন, সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে গুরুত্ব দেন না সভাপতি সমীর চন্দ। স্মৃতির বক্তব্যের পর সমীর চন্দের বক্তব্য শুনতে চান ওবায়দুল কাদের। সমীর চন্দ বলেন, ‘আপা যে অভিযোগ দিলেন, উনিই বলুক, কোন কোন অনুষ্ঠানে তাকে ইগনোর করে আমি সংগঠনের কর্মসূচি করছি। সমীর চন্দের কথা বলার সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বারবার স্মৃতি বক্তব্য দিতে থাকেন। একাধিকবার এমন আচরণ করতে গেলে স্মৃতিকে থামতে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।
পরে দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আপনি তো সমীর চন্দকে কথাই বলতে দিচ্ছেন না।’ এ সময় আরও উত্তেজিত হয়ে বক্তব্য দেন উম্মে কুলসুম স্মৃতি। একপর্যায়ে বাহাউদ্দিন নাছিম স্মৃতিকে বলেন, ‘আপনি এমন আচরণ করছেন কেন? আপনি কি হাতির পাঁচ পা দেখেছেন?’ তখন স্মৃতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা হিসেবে এমন বক্তব্য আপনি দিতে পারেন না।’ এ কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, ‘এটা কেমন বক্তব্য, হাতির পাঁচ পা দেখা!’ এ সময় স্মৃতি আরও উচ্চস্বরে বাহাউদ্দিন নাছিমকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কিছু নেতার জন্য আজ কৃষক লীগ বিভক্ত।’ এ সময় ওবায়দুল কাদের সবাইকে থামতে বলেন এবং বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন।
সভায় শ্রমিক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আলাদা আলাদা কমিটি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ সময় ওবায়দুল কাদের শ্রমিক লীগকে আর কোনো কমিটি না দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, যেসব কমিটি একক স্বাক্ষরে হয়েছে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, বিভিন্ন সময়ে দেশের বিরোধী দলগুলো বলে যে, দেশের নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নেই। এ ছাড়া তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ দেয়। এসব ভিত্তিহীন কথার বিপরীতে তথ্যনির্ভর বক্তব্য দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানান ওবায়দুল কাদের।
সভার এক পর্যায়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি গঠনের বিষয়ে কথা ওঠে। ওবায়দুল কাদের তখন কমিটি গঠনের অগ্রগতি জানতে চান। ঢাকা মহানগর উত্তর থেকে জানানো হয়, তারা কমিটি ইতোমধ্যে জমা দিয়েছে। দক্ষিণ থেকে জানানো হয়, কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে। এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি দলের সাধারণ সম্পাদক। আমি বারবার বলার পরও কেন কমিটি দিতে দেরি হচ্ছে। কমিটি দিতে দেরি হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো।’ ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার তাগাদা দেন তিনি।
২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর সাদ্দাম হোসেনকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে আজ অবধি সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। আর ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর যুব মহিলা লীগের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি হন আলেয়া সারোয়ার ডেইজি এবং সাধারণ সম্পাদক হন শারমিন সুলতানা লিলি। এরপর থেকে এই সংগঠনেরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।
২৩ নভেম্বর ২০১৯ সালে শেখ ফজলে শামস পরশকে যুবলীগের চেয়ারম্যান ও মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির মেয়াদ চলে গেলেও এখনো ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের কমিটি গঠন করতে পারেনি। সভায় ঢাকা মহানগর যুবলীগের কমিটি দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। অন্যদিকে মহিলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। এ ছাড়াও সভায় আগস্ট মাস উপলক্ষে দলীয় কর্মসূচির প্রস্তুতি নিতেও বলেন ওবায়দুল কাদের।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘সব সহযোগী সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।’ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব রকম প্রস্তুতি আছে। যে কোনো সময় ঘোষণা হতে পারে।’
সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সভায় দলের নেতাকর্মীদের আরও প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতে বলা হয়।’