উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নেমে আসতে শুরু করেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এরইমধ্যে হাওরগুলো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। আশংকা বাড়ছে এমন বৃষ্টি আরো দিন দুয়েক চলতে থাকলে ডুবে যাবে নিম্নাঞ্চলসহ অনেক এলাকা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উজানে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে এই অঞ্চলের সুরমা, যাদুকাটা, সারিগোয়াইন, সোমেশ্বরি নদীর পানির উচ্চতা বাড়তে পারে। ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার কিছু অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদে বন্যা দেখা দিতে পারে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শামসুদ্দোহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, আগামী দুই দিনে সুনামগঞ্জ শহরের আশেপাশে হাওর এলাকার সাথে যুক্ত যেসব নিম্নাঞ্চল আছে সেগুলো প্লাবিত হতে পারে।
ভারতের সীমান্তের সাথে এই জেলার পাহাড়ি এলাকা থেকে পানির ঢল নেমে আসে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়েও সুনামগঞ্জ জেলাটিতে একটি আকস্মিক বন্যা হয়েছিল। তবে সেটি চার-পাঁচ দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি।
গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে বন্যা শুরু হওয়ার পর সেটি দীর্ঘসময় ধরে স্থায়ী হয়েছিল যাতে আর্থিক ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
ওই বন্যাও স্বল্পমেয়াদী হিসেবে শুরু হলেও পরে পানি নেমে যেতে বিলম্ব হওয়ায় সেটি দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় রূপ নেয়। প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিল।
একই বন্যায় ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
বৃষ্টি কতদিন থাকবে?
ঢাকাসহ সারা দেশে গত কয়েক দিন ধরেই থেকে থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ঢাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলাটিতে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ছাতকে। সেখানে ১৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময়ে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিকিম, অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, সারাদেশে যে বৃষ্টিপাত চলছে তা আপাতত বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
‘আগামী ১০ দিন বৃষ্টির ধারা এরকম অব্যাহত থাকবে। কোনো জায়গায় কমে যেতে পারে, কোনো জায়গায় বেড়ে যেতে পারে। কিছু জায়গায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কোনো চান্স নেই।’
বিভাগ অনুযায়ী, আগামীকাল থেকে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অনেকটাই কমে আসবে। অন্যদিকে রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা এবং সিলেটে বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং এসব বিভাগে আরো বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
‘দক্ষিণাংশে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমে আসতে পারে, কিন্তু উত্তরাংশে বৃষ্টির পরিমাণ মোটামুটি যেরকম আছে হয়তোবা কম-বেশি হতে পারে, বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নাই,’ বলেন শাহীনুল ইসলাম।
খুলনা বিভাগে এখন বৃষ্টি হলেও এটি সামনের দিনগুলোতে কমে যাবে বলেও জানান তিনি।
বন্যার আশঙ্কা কতটা?
সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, গত চার দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাদের জেলাতে।
যেসব হাওর এলাকা এতদিন শুকনা ছিল সেগুলো পানিতে ভরে গেছে। অবশ্য পানি এখনো রাস্তায় উঠে আসেনি।
তবে এরকমের বৃষ্টি আরো দুই-এক দিন স্থায়ী হলে পানি হাওর থেকে বসতি এলাকায় প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় এই বাসিন্দা।
পানি বাড়লে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ছাড়াও মধ্যনগর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুরের মতো এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে তিনি ভয় পাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর ছাতক পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে বন্যা হয়েছিল সেটি ছিল তীব্র বন্যা। সেরকম কোনো কিছুর আশঙ্কা তারা করছেন না। তবে বর্ষাকালে যে সাধারণ বন্যা হতে পারে সেটিই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই মৌসুমে যেমন স্বাভাবিক বন্যা হয় সেরকমই বন্যা হবে বলে ধারণা করছি।’
বাংলাদেশে সাধারণত, বর্ষাকালে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, এবং যমুনা-তীরবর্তী গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া- এসব জেলা শুরুতেই বন্যার ঝুঁকিতে থাকে।
পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জুলাই মাস ধরে যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকে সেটা এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
তার মতে- সিলেট, সুনামগঞ্জের নিম্ন এলাকা আগামী দুদিনের মধ্যে প্লাবিত হয়ে যেতে পারে। তবে পরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তবে তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের বৃষ্টি বাড়ছে এবং নদীতে পানি বাড়ছে।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য পুরোপুরি দেশের বাইরে উজান থেকে নেমে আসা ঢলকেই দায়ী করেছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম বড়ুয়া। তিনি বলেন, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বরাক এলাকার পানি নেমে আসার কারণেই বেশিরভাগ বন্যা হয়।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত পানি ঢলে নেমে আসলে তখন সেটি প্লাবন ডেকে আনে।
তিনি বলেন, গত বছর তিন চার দিনে প্রায় ২৫০০-২৬০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে হয়েছিল। সেই পানি ভাটির দিকে নেমে আসার কারণে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা দেখা দিয়েছিল।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের মতো প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করতে পারে। আর এ মাসের মাঝামাঝি থেকে সেটা বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
এই সময়ে মৌসুমী বন্যা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিন আমরা কোনো আশঙ্কা করছি না। জুলাই মাসের শেষ অর্ধভাগে আমরা আশঙ্কা করছি, তখন হয়তো আমাদের মৌসুমী বন্যা যেটা শুরু হওয়ার কথা সেটা শুরু হতে পারে,’ বলেন পার্থ প্রতীম বড়ুয়া।
সিরাজগঞ্জ ও এর উপরে অর্থাৎ গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ- এই এলাকায় তখন বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
তবে এবার দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কোনো আশঙ্কা এখনো করছে না বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র।
সূত্র : বিবিসি