ঢাকা: দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বেআইনিভাবে অর্থ গ্রহণ করছেন। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আত্মীয়করণ। কোনও কোনওটিতে এই অবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গোচরে থাকলেও, লিখিত প্রমান না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজনরা একসঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ড ও নির্বাহী পদেও রয়েছেন। জমি কেনা, দরপত্র ইত্যাদিতেও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ভর্তিতে লাভের অংশ এবং মাসিক হারে বেতন বা অংশীদারিত্বের অর্থও বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা।
সম্প্রতি বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাবস্থা নেওয়ারও উদ্যেগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়টির চেয়ারম্যান ও উপাচার্য আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেকের স্ত্রী সালেহা সাদেক ও ছেলে জাফর সাদেকও রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে। আর ভেতরের খবর হচ্ছে গোড়া থেকেই আত্মীয়করণের দোষে দুষ্ট এই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি।
সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে গঠন করা ট্রাস্টিতে মুহাম্মদ সাদেকের শ্বশুর, খালাতো ভাইসহ আরো অনেকেই ছিলেন। তবে ওই ট্রাস্টি বোর্ডেরই কিছু সদস্য অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনে সাদেকের বিরুদ্ধে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ড ভেঙ্গে দেন তিনি। এরপর ২০১২ সালের শেষ দিকে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন।
এশিয়ান ইউনির্ভাসিটির এই অব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
ইউজিসি সূত্র জানায়, একক মালিকানাধীন প্রায় সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডেই রয়েছেন মালিকের স্বজনরা।
ইউনিভার্সিটি লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের- ইউল্যাব’র ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন এর প্রেসিডেন্ট কাজী শাহেদ আহমেদের পরিবারের সদস্যরা। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন কাজী আনিস আহমেদ, সদস্য হিসেবে রয়েছেন কাজী নাবিল আহমেদ, কাজী ইনাম আহমেদ।
নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিতে ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর স্বজনেরা। মেয়ে লাবিবা আব্দুল্লাহ এবং ছেলে সাদ আল জাবির আব্দুল্লাহকেও রাখা হয়েছে ট্রাস্টি বোর্ডে।
আইইউবিএটি’তে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলিমুল্লাহ নিজেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের তথ্য জানা যায়নি। তবে সূত্র জানায়, এখানেও ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও ছেলে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হান্নান ফিরোজ। বোর্ডে সদস্য হিসেবে স্ত্রী ফাতিনাজ ফিরোজ ছাড়াও রয়েছেন মেয়ে ফারহানাজ ফিরোজ এবং জারহানাজ ফিরোজ।
গত ১২ বছর ধরেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুল মান্নান চৌধুরী। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ট্রাস্টি বোর্ডের কোন তালিকা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ট্রাস্টিতে রয়েছেন তার স্ত্রী মোর্শেদা চৌধুরী। যিনি একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধক্ষ্যের দ্বায়িত্বও পালন করছেন। এছাড়াও ছেলে মুনতাসির মান্নান চৌধুরীও রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সবুর খান। স্ত্রী শাহানা খান ছাড়াও ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন শ্যালক ইমরান হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন পরিচালক বুধবার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়তেই এ ধরনের ঘটনা রয়েছে। এটা সবাই জানে। কিন্তু চাকুরিরতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ঘটনা জেনেও অভিযোগ করেন না।
ট্রাস্টি বোর্ডে পরিবারের সদস্যদের নিতে আইনগত বাধা নেই। কিন্তু তা যদি স্ত্রী, ছেলে মেয়ের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার মান হারাতে বাধ্য। আর অনিয়ম অব্যবস্থাপনাও জেকে বসে এসব প্রতিষ্ঠানে, বলেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে কেবল বোর্ডে থাকাই নয় বেরিয়ে এসেছে কারণে অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে তাদের অর্থ নেওয়ার তথ্য। সূত্র জানায়, এই স্বজনেরাই বিভিন্ন খাত দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ উত্তোলন করেন।
এছাড়াও নানা ধরনের দুর্নীতিতেও রয়েছে তাদের অংশগ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জমি ক্রয় থেকে শুরু করে ছোটখাটো দরপত্রেও থাকে ট্রাস্টিদের দূর্নীতি।
পরিবার পরিজন নিয়ে চলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরাও যথেচ্ছাচার চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজেরা নিজেরা হওয়ায় অভিযোগ করার বিষয়টিও অনেকটা অবাস্তব হয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মৃত্যুর পর ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। ২০১৪ সালের মার্চে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে দেয়া এক তথ্যে জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ট্রাস্টি মাস শেষে সন্মানী হিসেবে ১ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত তুলছেন।
তবে শুধু স্বজনেরাই নন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরাও মাস ভিত্তিতে টাকা উত্তোলন করছেন। আবার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা শুধু বেতন ছাড়াও নিয়োগ এবং বিভিন্ন দরপত্রে বাণিজ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইউসি)তে চলছে বড় ধরনের অনিয়ম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য জানান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আনম শামসুল ইসলাম চট্টগ্রাম জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি এখন জেলে রয়েছেন। দলীয়করন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ এবং দরপত্র বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ট্রাস্টিরা প্রয়োজনে অর্থ প্রদান করবে, তবে উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।