উত্তাল মণিপুর, শান্তি ফিরছে না কেন?

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্য ফের উত্তাল। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষ যেন থামছেই না। গত বুধবার মণিপুর মন্ত্রিসভার একমাত্র নারী সদস্য কাংপোকপি কেন্দ্রের বিধায়ক নেমচা কিপগেনের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এ ছাড়া একইদিনে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ জন। এরপরের দিন গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানী ইম্ফলের একটি বাজার এলাকায় বেশ কিছু বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, হামলাকারীদের আটকাতে পুলিশ সেখানে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ সহিংসতায় নিহতরা সবাই মেইতেই জনগোষ্ঠীর সদস্য। মে মাস থেকে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতায় এখনও পর্যন্ত ১০০ এর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন তিন শতাধিক।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মণিপুরের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীর। এদের অনেকেই বৈষ্ণব। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ তারাই। অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করেন যেসব নাগা এবং কুকি উপজাতির মানুষ, তাদের একটা বড় অংশ খ্রিস্টান। এরকম ৩৩ টি উপজাতি গোষ্ঠীর বসবাস রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে।
রাজ্যজুড়ে কড়া নিরাপত্তা

গত কয়েক বছর ধরেই মেইতেইরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন যে তাদের তপশিলি উপজাতি (এসটি) হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করার জন্য। ভারতে যে সব সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে – তাদেরকে এসটি শ্রেণীভুক্ত করে তাদের জন্য সরকারি চাকরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা হয়।

গত মাসে মণিপুর হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি বিবেচনার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাজ্যের অন্য উপজাতিগুলোর মধ্যে এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যে মেইতেইদেরকে এসটি মর্যাদা দেওয়া হলে তাদের চাকরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।

সংঘর্ষ শুরু হওয়ার দুদিনের মধ্যেই সেনা ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করা হয় মণিপুরে। আবার রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলগুলি, যেখানে উপজাতীয়দের বসবাস, সেখানে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ জায়গা জমি কিনতে পারেন না। তবে মেইতেইরা উপজাতি তালিকাভুক্ত হলে পার্বত্য অঞ্চল তারা দখল করে নেবে, এই আশঙ্কাও তৈরি হয় উপজাতিগুলির মনে।

মনিপুরের একজন অগ্রগণ্য মানবাধিকার কর্মী ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে নাম উল্লেখ করতে বারণ করে বিবিসিকে বলন, মেইতেইরা রাজনৈতিকভাবে খুবই ক্ষমতাশালী। কিন্তু নাগা এবং কুকিসহ উপজাতীয় মানুষ সংরক্ষণের কারণে এবং তাদের পিছনে খ্রিস্টান মিশনারিদের সহায়তার কারণে পড়াশোনা বলুন বা রাজ্যের ভেতর আর বাইরে চাকরীর ক্ষেত্রে, খুব দ্রুত উন্নতি করে ফেলেছে মেইতেইদের তুলনায়। তাই মেইতেই মধ্যবিত্তদের একাংশ মনে করছিলেন যে তাদেরও সংরক্ষণের আওতায় আসা উচিত, যাতে তারাও উন্নতি করতে পারে।

এরপর হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিবাদ জানাতে মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকা এক মিছিলে হাজার হাজার লোক যোগ দেয় মে মাসের ৩ তারিখ। ওইসব মিছিলগুলির একটি হচ্ছিল উপজাতীয়দের এলাকা চূড়াচন্দ্রপুর জেলায়। সেখানেই সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর বিষ্ণুপুর এবং আরও কয়েকটি এলাকা থেকেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়।

মেইতেই সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ যেমন উপজাতীয়দের এলাকা থেকে পালাতে থাকেন, তেমনই রাজধানী ইম্ফলের মতো উপত্যকা এলাকা, যেখানে মেইতেরাই সংখ্যাগুরু, সেখান থেকে পালাতে থাকেন উপজাতীয় মানুষরা।

বিবিসি বলছে, লাগাতার গুলি চলে, বোমাবাজি হয়, হাজার হাজার বাড়ি, দোকান আর যানবাহনে অগ্নিসংযোগ হতে থাকে গোটা রাজ্যে। নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে লুঠ হয়ে যায় প্রায় এক হাজার আধুনিক অস্ত্র, যার মধ্যে অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে এলএমজি, সবই আছে।

প্রাথমিক সহিংসতা বন্ধ হলেও তা পুরোপুরি থামে নি। যদিও এরই মধ্যে একাধিকবার শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। জাতিদাঙ্গায় উভয় সম্প্রদায়েরই বহু ঘরবাড়ি, দোকান ধ্বংস হয়ে গেছে।

দিল্লি ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপের পরিচালক সুহাস চাকমা বলেন, জাতিগত সহিংসতার শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার উভয়েই তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রথমত যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতিতে রয়েছে, তারা ডেসিগনেটেড ক্যাম্পগুলো থেকে বেরিয়ে হামলা চালাতে পারছে কী করে? সেটা নজরদারির দায়িত্ব কার ছিল? আবার হাজার খানেক অত্যাধুনিক অস্ত্র মণিপুর পুলিশের কাছ থেকে লুঠ হয়ে গেল, তার মধ্যে মাত্র শ’দেড়েক ফেরত এসেছে। এটা কি সম্ভব যে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছ থেকে অ্যাসল্ট রাইফেল, এলএমজি এসব কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই? আর সেই সব অস্ত্র ফেরত পাওয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসন কী করছে, না তারা একটা বড় বাক্স রেখেছে যেখানে আবেদন করা হচ্ছে যাতে মানুষ অস্ত্র ফেরত দিয়ে যান। এটা কি ছেলেখেলা হচ্ছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *