আগস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করতে পারে বলে বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন৷ বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার এক বৈঠক নিয়ে ব্রিফিংয়ের সময় সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘ব্রিকস ব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ব্যাংকে আমাদের সদস্য করেছে৷ আগামীতে তারা ব্রিকসে বাংলাদেশকে সদস্য করবে, আগস্ট মাসে ওদের সম্মেলন আছে৷ প্রধানমন্ত্রী ইনশাল্লাহ সেখানে যাবেন৷’
ব্রিকস হলো উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট।
সবশেষ ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত হবার পূর্বে এই সঙ্ঘটি “ব্রিক” নামে পরিচিত ছিল।
মূলত উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ উর্ধ্বমুখী। সেইসাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর উপর তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তাই এই জোটকে বেশ প্রভাবশালী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
ব্রিকসের ৫ম সদস্য দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে পর, দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর আর্থিক জোটটিতে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া গেল বলে সরকার বলছে৷
আগামীতে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় আটটি দেশ এই জোটের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে আরও ১৯টি দেশ জোটে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে ব্রিকস বিষয়ক বিশেষ দূত অনিল সুকলালের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
ব্রিকস আরো সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সম্ভাবনা দেখার জানিয়েছেন জোটের নেতারা। এবারের সম্মেলনে জোট সম্প্রসারণের বিষয়ে তারা আলোচনা করেন।
সদস্য দেশগুলো ২০১৫ সালে তাদের নিজস্ব অর্থ-শক্তিতে নিজেদের ব্যাংক চালু করে৷ পরে অবশ্য এর নাম পাল্টে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক করা হয়৷
২০২১ সালে ব্যাংকে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেয় বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যাংকের পাশাপাশি এখন ব্রিকস জোটেও যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷
ব্রিকস-এ যোগদানের সুবিধার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের অর্থায়নের আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে৷ আমাদের তো টাকা পয়সা দরকার৷ সেদিক থেকে এটা ভালো হবে৷’
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে এই ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
তারা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখছেন। যা বহুজাতিক এই জোটের অর্থনৈতিক সহযোগিতার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ খুলে দিতে পারে।
তাদের মতে, ব্রিকস বাংলাদেশের চাইতে বড় অর্থনীতির দেশের জোট। এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো জনসংখ্যার দিক থেকেও একেকটি বৃহৎ দেশ।
এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলোর সাথে যদি জোটভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা ইতিবাচক হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর মতো ব্রিকস ব্যাংক থেকেও বড় ধরণের বিনিয়োগ ও ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে তিনি মনে করছেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে, এই রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরণের লেনদেন বা বাণিজ্য সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সুবিধা পাওয়া যাবে। সেইসাথে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঋণ পাওয়াও সহজ হবে।’
ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠা অবজারভার ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী জনসংখ্যা, আয়তন এবং অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে ব্রিকস জোট বর্তমান বিশ্বের একটি বড় শক্তি।
২০১৪ সালের হিসেবে, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশে প্রায় ৩২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।
এই পাঁচ দেশ পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক জিডিপি’র প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর।
এমনকি বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (৮ ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে এই পাঁচটি দেশ থেকে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্রিকসের সাথে বাংলাদেশের জোটভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধার জায়গা হচ্ছে, ভারত, রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের মিত্র দেশ। চীন ও ভারত একইসাথে প্রতিবেশী।
তাদের সাথে জোট বাঁধলে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা মতো দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বেশ আগে থেকেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, ব্রিকস মুদ্রা প্রবর্তন এবং নিজস্ব রিজার্ভের কথা বলে আসছে।
এটি কার্যকর হলে ব্রিকস দেশগুলো তাদের নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। এতে ডলারে নির্ভরতা কমবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি থাকার কারণে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন সীমিত আকারে হতে হবে। নাহলে বাণিজ্যে ঘাটতিতে থাকা দেশ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে এই জোটে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে জোটভুক্ত কিছু দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ততটা মসৃণ না।
এ কারণে তাদের নিজস্ব রিজার্ভ ও নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, সেইসাথে বাণিজ্যিক লেনদেন এবং ঋণ আদান-প্রদান কতোটা কাজ করবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না- এমনটাই মনে করেন সায়মা হক বিদিশা।
ব্রিকস একটি বহুজাতিক সংস্থা। এই জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য, অর্থনৈতিক কাঠামো বা সাংস্কৃতিতে বড় ধরণের ফারাক আছে। প্রতিবেশী হলেও চীন ও ভারতের সম্পর্কও বেশ জটিল।
বিদিশা বলেন, ‘এই জোটের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হল তাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জোটের সব দেশগুলোর মধ্যে কতটা ঐক্যমত্য রয়েছে তা খুব জরুরি। বিশেষ করে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন বা নিজস্ব রিজার্ভের মতো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে সেগুলো কেবল প্রস্তাবনা আকারেই পড়ে থাকবে।’
চীন ও রাশিয়ার জোটে যোগ দিলে পাশ্চাত্যের রোষানলে পড়ার ঝুঁকি কতটা থাকবে বাংলাদেশের?
সায়মা হক বিদিশা মনে করেন নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় এখন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি এই রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয় সেটা পশ্চিমাদের চাওয়ার বিপরীতমুখী হতে পারে। আবার রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধও একটা বিষয়। কিছুটা টেনশন তো থাকবেই। কিন্তু ধারণার ওপর ভিত্তি করে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। হয়তো জোটভুক্ত হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সুসম্পর্ক বজায় রাখবে।’
এ বিষয়ে আবু আহমেদ জানান, বাংলাদেশ বাজার মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ-নির্ভর। বিনিয়োগও ওইসব দেশ থেকেই বেশি আসে। তাই জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চিমাদের চাপে পড়তে পারে।
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে লাভক্ষতির হিসাবটা সরকার যেন ঠিক মতো করে নেন- পরামর্শ আবু আহমেদের।
সূত্র : বিবিসি