ক্রসফায়ার, গুম এবং র‌্যাবের অন্তিম গন্তব্য

বাধ ভাঙ্গা মত

motamot-head_23888_1_53584ঢাকা: প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবকে এবারের মতো এত বড় বিতর্কের মুখে সম্ভবত পড়তে হয়নি। শুরুর দিকে কিছু কিছু ঘটনায় বেশ প্রশংসিত হয়েছে এরা। বিশেষ করে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে সশস্ত্র চরমপন্থিদের দমনে খুবই সাফল্য দেখিয়েছে। এরপর কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী ধৃত এবং ক্রসফায়ারে নিহত হয়। ক্রসফায়ার বিষয়টি এত ঘন ঘন ঘটতে থাকে এ সময়ে যে, এর সত্যতা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দেখা দেয়। এরপর এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। অনেককে তখন বলতে শোনা গেছে, এই সব শীর্ষ সন্ত্রাসী এর আগে তো বহুবার ধরা পড়েছে, জেলে গেছে। কিন্তু আটকে তো রাখা যায়নি। বরং জেল থেকে বের হয়ে এসে আগের চেয়েও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। অনেকে তো জেলখানায় থেকেও অব্যাহত রেখেছে তাদের অপরাধ কার্যক্রম। তাই প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা যেহেতু তাদেরকে থামাতে পারছে না, তখন ক্রসফায়ারে নিকাশ হওয়াটা বরং মন্দের ভালো।

সন্দেহ নেই, যুক্তি হিসেবে এটা তেমন জোরালো নয় এবং কিছুটা কু-যুক্তিই। এরপরও ওই সময়ে দেখেছি ক্রসফায়ার নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা উসখুস ভাব থাকলেও সেটা কখনো প্রকাশ্য সমালোচনার পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু এরপর যতই সময় গেছে, বেড়েছে ক্রসফায়ার নিয়ে মানুষের সন্দেহ। যখন সেই ‘ক্রসফায়ার’ শীর্ষ সন্ত্রাসীর গ-ি পেরিয়ে ব্যবহৃত হতে থাকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষের ওপর, ক্রমশ সেই সন্দেহ পরিণত হলো উদ্বেগ আর আতঙ্কে।

ঝালকাঠির লিমনের কথাই ধরা যাক। লিমনের পায়ে র‌্যাবের গুলি নিয়ে দেশজুড়ে অনেক হইচই হয়েছে। এ নিয়ে এত বেশি লেখালেখি হয়েছে যে, বিষয়টা আসলে কি ঘটেছে তা বুঝতে কারও আর বাকি নেই। এত কিছুর পরেও র‌্যাব কিন্তু একচুল নড়েনি তাদের সেই মুখস্থ গল্প থেকে। অনেককে এমনও বলতে শুনেছি, গুলি যদি পায়ে না লেগে লিমনের বুকে লাগত, তাহলেই আর কোনো ঝামেলায় পড়তে হতো না র‌্যাবকে। ‘ক্রসফায়ার’-এর বিশাল তালিকায় আর একটি সংখ্যাই কেবল বাড়ত।
তবে লিমনের এই ঘটনার পর থেকেই সম্ভবত কিছুটা কমতে থাকে ক্রসফায়ার, আর সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে গুমের ঘটনা। একটা মানুষ হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না, আর পাওয়া গেলেও অনেক দিন পর হয়ত মিলছে তার লাশ, ভেসে উঠছে কোনো নদী বা ডোবায়। গুমের ঘটনাতেও অবধারিতভাবে চলে আসছে র‌্যাবের নাম। র‌্যাব পরিচয়ে কিছু সশস্ত্র লোক মানুষের বাড়িতে ঢুকে কোনো একজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তার আর কোনো সন্ধান মিলছে না। এ নিয়ে র‌্যাব অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা সরাসরি অস্বীকার করছে। বলছে না, এ রকম কাউকে তারা ধরে আনেনি। ব্যাস, এভাবেই গুম হয়ে যাচ্ছে জলজ্যান্ত একজন মানুষ। এ নিয়ে বাদ প্রতিবাদের আর কোনো সুযোগ থাকছে না।

ঠিক আছে, র‌্যাব তাকে ধরে নিয়ে যায়নি, তাহলে কারা ধরে নিয়ে গেল? এই অপহরণকারীদের ধরাও কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ নয়। র‌্যাবকে কিন্তু কখনোই দেখা যায়নি ওই অজ্ঞাত অপহরণকারীদের ধরার জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে। বরং দেখা গেছে ‘আমরা ধরে আনিনি’ এই কথাটুকু উচ্চারণের মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করতে। আর এই আচরণ থেকেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে জনগণ।

গুম প্রজেক্টের বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা গেছে গত চার-পাঁচ বছর ধরে। বলা যায়, একেবারে শুরু থেকেই এই ‘গুম’ অস্ত্রটি ব্যবহার হতে থাকে বিরোধী রাজনীতিবিদদের ওপর। ক্রসফায়ারের তুলনায় এটা অনেকটাই নিরাপদ এ কারণে যে, এখন আর আলাদা করে কোনো গল্প বানাতে হয় না। ‘আমরা ধরে আনিনি,’ ‘কে ধরে নিয়ে গেছে, বলতে পারব না’Ñ  এই রকম দু-একটা আপ্তবাক্য উচ্চারণের মাধ্যমেই শেষ করে দেওয়া যায় এই অধ্যায়। চৌধুরী আলম এবং ইলিয়াস আলীর মতো বিএনপি নেতা সফলভাবে গুম হয়ে যাওয়ার পর এ ধারা যে দ্রুততার সঙ্গে বাড়তে থাকবে এই ধারণা নিয়ে আর গবেষণা করতে হয়নি। বলা বাহুল্য বেড়েছে তা এবং সেটা বেশি বেশি প্রয়োগ হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপরেই। তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার, সব গুমের পেছনেই যে সন্দেহভাজন হিসেবে র‌্যাবের নাম উচ্চারিত হয়েছে তা হয়ত নয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের নামই এসেছে।

একটা উদাহরণের দিকে তাকানো যাক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর আগের দুই তিন মাস রাজধানীতে বিরোধী আন্দোলন বেশ দানা পাকিয়ে উঠছিল। ঠিক এই সময়েই নগরীতে কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গুম হতে থাকে। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরÑ কেবল এই দুই মাসেই ঢাকা মহানগরী থেকে একে একে ২২ জন বিএনপির নেতা-কর্মী গুম হয়ে যান। এদের প্রায় প্রত্যেককেই যার যার বাড়ি থেকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহৃতদের আত্মীয়স্বজন পরে র‌্যাব অফিসে যোগাযোগ করেছে কিন্তু কোনো সন্ধান পায়নি, র‌্যাব অস্বীকার করেছে তাদের তুলে নিয়ে আসার কথা। রাতারাতি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছেন এই নেতা-কর্মীরা।

অনেককেই বলতে শুনি, দেশে এই মুহূর্তে কোনো শক্তিশালী বিরোধীদল নেই। ৫ জানুয়ারির মতো একটা ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও, দেশজুড়ে নানা অন্যায়-অত্যাচার-অনিয়ম হওয়ার পরও কেন বিশাল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কিছু করতে পারছে না? কেন বিএনপি নেতা-কর্মীদের দেখা যাচ্ছে না রাজপথে? এতসব প্রশ্নকে যখন চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী কিংবা মহানগরীর ওই ২২ নেতা-কর্মীর পরিণতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, তখন আর বিস্মিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ থাকে না।

এ কথা সত্য, রাজনৈতিক গুম-খুনগুলোর পেছনে যদি আসলেই র‌্যাবের হাত থেকে থাকে, তাহলে এরও পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাত। তাদের প্রশ্রয়ে কিংবা চাপে পড়েই হয়ত এ ধরনের অপকর্ম করতে হয়েছে। রাজনীতিবিদদের হয়ে অন্যায় কাজ করতে করতে এক পর্যায়ে সশস্ত্র কোনো বাহিনীর সদস্যরা যদি নিজেদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে একই ধরনের অপকর্ম করতে শুরু করে, সেটাকেও কিন্তু খুব বেশি অস্বাভাবিক বলা যাবে না। হয়ত নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি সে রকমই কিছু।

তবে সবশেষ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবকে নিয়ে সারা দেশে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, এ থেকে এই বাহিনীটি কীভাবে বের হয়ে আসবে, তা যেন রীতিমতো গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এবার তাদের গায়ে ‘ভাড়াটে খুনি’র লেবেল লাগানো যায় কি না সে আলোচনাও চলছে অনেকের মধ্যে। যে বাহিনী নিয়ে সরকার এক সময় গর্ব করত, তাদের ভাবমূর্তির এই যে করুণ পতন, এটা সত্যই বেদনাদায়ক। র‌্যাবের জন্ম যাদের হাতে, সেই বিএনপিই এখন দাবি তুলেছে একে বিলুপ্ত করে দিতে। একই ধরনের দাবি উচ্চারিত হয়েছে দেশের সুশীল সমাজ এবং এমনকি বিদেশি দাতা সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও। এতসব দাবির বিপরীতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, র‌্যাব বিলুপ্তির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই দৃঢ় বক্তব্য কতটুকু স্থায়িত্ব পাবে বলা মুশকিল।
শেষ পর্যন্ত র‌্যাব যদি বিলুপ্তও হয়ে যায়, এরপরও মানতে হবে র‌্যাব দারুণভাবে সফল হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে। মাথায় পট্টি বাঁধা কালো পোশাকধারী এই বাহিনীকে দেখলে নিরীহ সাধারণ মানুষ এখন আর আশ্বস্ত হয় না বরং আতঙ্কিত হয়। র‌্যাব কাউকে ধরে নিয়ে গেলে হোক সে বড় অপরাধী, ছোটখাটো অপরাধী কিংবা একেবারেই নিরপরাধী, সবার মনে চিন্তা থাকে একটাই, আর তা হচ্ছে মৃত্যুভয়। তাই র‌্যাব ধরে নিয়ে গেলে স্বীকারোক্তি আদায় একেবারেই সহজ হয়ে যায়। র‌্যাবকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভীতিকর অনুভূতি, সন্দেহ নেই এটাই র‌্যাবের সবচেয়ে বড় অর্জন।

আমার নিজের যতটুকু মনে হয়, র‌্যাবের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, এদের নিয়ে যে বিতর্ক আর আতঙ্ক আজ জনমনে, এমন একটি বাহিনীর টিকে থাকা কষ্টকর। আমরা স্মরণ করতে পারি রক্ষী বাহিনীর কথা। প্রবল পরাক্রমশালী সেই বাহিনীও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। রক্ষীবাহিনী এখন ইতিহাস, কালো ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সেই বাহিনীকে নিয়ে হয়ত প্রচলিত আছে নানা গল্প, কৌতুক। হয়ত কয়েক বছর পর র‌্যাবকে নিয়েও তেমন কিছু কৌতুক শোনা যাবে।
সম্ভাব্য তেমন একটা কৌতুক দিয়েই না হয় শেষ করা যাক আজকের লেখা।

মন্ত্রী মশায় সপরিবারে অবসর বিনোদনে গেছেন জঙ্গলের ধারের রিসোর্টে। তার আদরের কন্যার ততধিক আদরের খরগোশ ‘পিংকি’ হঠাৎ করেই জঙ্গলে ঢুকে গেল, আর ফিরে এলো না। কন্যা কান্না করছে, পিতার মন খারাপ। ডাকলেন তিনি পুলিশ বাহিনীকে। মন্ত্রীকন্যার খরগোশ বলে কথা। পুলিশ পুরো জঙ্গলটা ঘিরে ফেললো। এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজলো। বনে অনেক প্রাণী পাওয়া গেলেও খরগোশটিকে পাওয়া গেল না। তারা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিলো।

মন্ত্রী ডাকলেন ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চকে। ডিবি এসেই বনের চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে ফেললো। এরপর বনের মধ্যে ঢুকে প্রতিটি প্রাণীকে তালিকাভুক্ত করলো, গাছগুলোর তালিকা করলো। বড় প্রাণী, ছোট প্রাণী, বড় গাছ, ছোট গাছÑএভাবে একটা ডাটাবেজ করলো। তারপর সেই ডাটাবেজ কম্পিউটারে মন্ত্রীকে দেখিয়ে প্রমাণ করে দিল বনের মধ্যে আর যা-ই থাক পিংকি নেই। তারা এমন ইঙ্গিতও করলো, খরগোশটিকে সম্ভবত বড় কোনো প্রাণী খেয়ে ফেলেছে।

মন্ত্রী সাহেব এবার ডাকলেন র‌্যাবকে। র‌্যাবের একটা বাহিনী ঢুকে গেল বনের মধ্যে। প্রথমেই তাদের সঙ্গে দেখা হলো একটি কুকুরের। জিজ্ঞাসা করলোÑতুমি কি খরগোশ পিংকি? জবাবে কুকুরটি না-সূচক মাথা নাড়তেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। এভাবে একটি একটি করে যে প্রাণীই সামনে এলো, জিজ্ঞাসা করলো একই প্রশ্ন। ‘না’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি। কিছুক্ষণ পর র‌্যাব সদস্যরা বীরদর্পে বন থেকে বের হলো। তাদের হাতে আধমরা একটা শূকর। শূকরটি ভালোভাবে হাঁটতেও পারছে না। কিন্তু তাড়স্বরে বলছে, আমিই পিংকি, আমিই পিংকি!
লেখকঃ মাসুদ কামাল
ইমেইল : [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *