বরিশালের বাচ্চু মিয়া একজন রেমিট্যান্সযোদ্ধা। সৌদি আরবে কর্মরত। স্বজনদের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপনে চার বছর পর দেশে ফিরেছেন তিনি। আসার সময় ২টি স্বর্ণবার কিনে নিয়ে এসেছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর এগুলোর শুল্ক দিতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক বনে যান তিনি। কারণ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একটি স্বর্ণবারের জন্য ৪০ হাজার টাকা শুল্ক রেখেছে; আরেকটি জব্দ করে তার হাতে একটি রসিদ ধরিয়ে দিয়েছে। এটি গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা।
কাস্টমসের ওই রসিদে উল্লেখ করা হয়েছে- ১ জুন ২০২৩ জাতীয় বাজেট ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা ২০১৬ অনুযায়ী, একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণবার ঘোষণা সাপেক্ষে সব প্রকার শুল্ককর পরিশোধ করে নিতে পারতেন। কিন্তু ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী, বিদ্যমান ব্যাগেজ-সুবিধার অতিরিক্ত স্বর্ণবার পরবর্তী আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য সাময়িকভাবে আটক করা হলো।
রসিদ পড়ে আকাশ ভেঙে পড়ে বাচ্চু মিয়ার মাথায়! গতকাল শনিবার তিনি আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে বাংলাদেশের নতুন বিধিনিষেধ আমি জানতাম না। নতুন নিয়মকানুনগুলো প্রবাসীদের জানানোর দায়িত্ব সরকারের যে দপ্তরগুলোর, সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরই এসব বিষয়ে আমাদের জানায়নি। জানালে এত টাকা দিয়ে স্বর্ণবার কিনে এনে এমন বিপাকে পড়তাম না। নিয়ম অনুযায়ী একটাই আনতাম। হুট করে নিয়ম পরিবর্তন করে প্রয়োগ করা অন্যায়, বলেন হতাশাগ্রস্ত বাচ্চু মিয়া।
শুধু বাচ্চু মিয়াই নন, গত ১ জুন ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী নতুন ব্যাগেজ রুলসের গ্যাঁড়াকলে পড়ে গত ১০ দিনে তার মতোই ভীষণ বিপাকে পড়েছেন ৫ শতাধিক যাত্রী। এতদিন যে কোনো প্রবাসী প্রতি ভরি স্বর্ণের বিপরীতে দুই হাজার টাকা করে শুল্ক দিয়ে দুটি বার আনতে পারতেন। বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে দুটি স্বর্ণের বার নিয়ে এলে দেশে তা বিক্রি করলে কমবেশি তিন লাখ টাকা মুনাফা হতো। বিধিসম্মত এ সুযোগটা কাজে লাগাতেন অনেক প্রবাসীকর্মী। গত ১ জুন পেশ করা বাজেটে ব্যাগে করে স্বর্ণ আনার সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়; বাড়িয়ে দেওয়া হয় কর। নতুন বিধিনিষেধ অনুযায়ী, প্রবাসীরা একটি করে স্বর্ণবার সঙ্গে আনতে পারবেন, দুটি নয়। এ ছাড়া ভরিপ্রতি কর দিতে হবে চার হাজার টাকা, দুই হাজার নয়। অর্থমন্ত্রী সেদিনই জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ একটির বেশি বার আনলে সেটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব করা বাজেট সংসদে অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে আগামী জুলাই থেকে। তবে সরকারের প্রচলিত বিধান অনুযায়ী যদি নতুন করারোপ করা হয়, তাহলে সেটি কার্যকর হয় সঙ্গে সঙ্গে। ফলে ১ জুন দুপুরের পর থেকেই দুটি স্বর্ণের বার আনার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে নতুন এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর শুধু প্রথম তিন দিনে ৩২০ জন প্রবাসীর কাছ থেকে ১১৭ গ্রামের একটি করে বার জব্দ করা হয়। তারা কেউই নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। গত ১০ দিনে এমন শত শত যাত্রীর কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রায় আধা মণ স্বর্ণ। আগে থেকে ঘোষণা না দিয়ে বা কোনো প্রচারণা না চালিয়ে এভাবে হঠাৎ করে কাস্টমসের নতুন নিয়ম কার্যকর করাকে অন্যায় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই। জব্দ স্বর্ণ ফেরত পেতে তারা এখন ধরনা দিচ্ছেন ঢাকা কাস্টমস হাউসে। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাগেজ রুলসের নিদের্শনা জানতে চলতি সপ্তাহে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে ঢাকা কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ।
ধামরাইয়ের আল আমিন ৮ জুন আসেন দুবাই থেকে। আসার সময় ১টি স্বর্ণের বার নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু স্বর্ণের বার ঘোষণা না দিয়ে নিয়ে আসায় তার স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। দীর্ঘদিন সৌদিতে কাজ করে গত ১ জুন দেশে ফেরেন প্রবাসী শেখ আয়াত। সঙ্গে বোনের বিয়ের গয়না তৈরির জন্য নিয়ে আসেন ২টি স্বর্ণের বার। শুল্ক দিতে গেলে ১টি স্বর্ণের বার জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমি যখন প্লেনে ওঠি তখনো এমন নিয়ম ছিল না। বোনের বিয়ের গয়না বানাবার জন্য ২টি স্বর্ণের বার কিনেছিলাম। ১টি জব্দ করা হয়েছে। এই ক্ষতি তো আমার পক্ষে পোষানো সম্ভব নয়। বাজেট ঘোষণার আগেই ময়মনসিংহের আবদুল মোমেন দুটি স্বর্ণবার নিয়ে বাংলাদেশের পথে বিমানে চড়েন। দেশে নামার পর জব্দ করা হয় তার একটি স্বর্ণবার। ক্ষোভের সঙ্গে আব্দুল মোমেন জানান, ছয় বছর আগে তিনি সৌদি আরব যান। কোভিডের সময়ও দেশে আসেননি। চলতি বছরের শুরুতে ছুটি পেয়ে ফেরেন। ছুটি শেষে গত ১৯ মে তিনি আবার কর্মস্থল সৌদির সেই মোটর পার্টস কোম্পানিতে যান। কিন্তু তাকে নতুন কাজ খুঁজতে বলা হয়। সে পথে না গিয়ে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গত মে মাসের শেষ দিকে দুটি স্বর্ণের বার কেনেন মোমেন। দাম নেয় সাড়ে ৫৫ হাজার রিয়েল। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ১৬ লাখ টাকার মতো। দেশে বিক্রি করে পাওয়া যাবে ১৯ লাখ টাকার বেশি। এই বাড়তি তিন লাখ টাকা মুনাফা এবং পুঁজি নিয়ে দেশে কিছু করার চেষ্টা করবেন, এই ছিল তার পরিকল্পনা। তার ফ্লাইট উড়াল দেয় ১ জুন স্থানীয় সময় ভোর ৩টায়। তখনো অর্থমন্ত্রী তার বাজেট পেশ করেননি। রাত সাড়ে ১১টায় তিনি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখন তার সঙ্গে আনা দুটি স্বর্ণের বারের একটি অবৈধ হয়ে যায়। আগের চেয়ে দ্বিগুণ কর দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন মোমেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারটি জব্দ হয়ে যাবে, এটি শুনে হতভম্ব হয়ে যান তিনি। তর্কাতর্কির পর তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক আদায় করে পাসপোর্ট ও আরেকটি স্বর্ণের বার রেখে দেন কাস্টমসের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী মোমেনের জব্দ করা ১০ তোলার ওই স্বর্ণের বারের দাম ৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এই স্বর্ণ ছাড় করার আশায় ঢাকা কাস্টমস হাউসে বারবার ধরনা দিচ্ছেন তিনি। সেদিন মোমেনের মতো আরও ১০৭ জনের বার জব্দ করা হয় শাহজালাল বিমানবন্দরে। পরের দুদিন জব্দ হয় আরও ২২৩ জনের।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, কাস্টমস ও ভ্যাট সংক্রান্ত বিষয় সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ‘যাত্রী ব্যাগেজ রুলস’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের অধীনে প্রণয়ন হওয়ায় বাজেট অধিবেশন থেকেই তা কার্যকর করা হয়েছে। প্র্রবাসীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে নির্দেশনা পেতে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুক্তভোগী প্রবাসীদের স্বর্ণ কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে কথা হয়েছে। এনবিআর পরামর্শ দিয়েছে, কিছু জরিমানা দিয়ে স্বর্ণ ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের ডিসি (প্রিভেন্টিভ) মুকাদ্দেস হোসেন গতকাল শনিবার আমাদের সময়কে জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালায় যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী কাজ করছে কাস্টমস হাউস। একটির বেশি স্বর্ণবার আনলে জব্দ করা হবে; জব্দ করা হবে ঘোষণা ছাড়া আনলেও। নতুন নিয়মে ইতোমধ্যে যেসব যাত্রীর স্বর্ণ আটক হয়েছে। সমস্যা নিরসনে এনবিআরের কাছে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের ব্যাপারে সরকার পরবর্তীকালে যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।