দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোতে চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে বেড়ে গেছে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন। গ্যাস-কয়লার পাশাপাশি এখন সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ফার্নেস অয়েলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট। সংকটময় পরিস্থিতি সামাল দিতে ফার্নেস অয়েলের প্রতি সরকারের নির্ভরতা বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন উদ্বেগের খবর হচ্ছে- এ মুহূর্তে দেশে ফার্নেস অয়েলের যে মজুদ রয়েছে, তাতে আর মাত্র ১০ দিন চলবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য। এর মধ্যে ফার্নেস
আমদানি করা সম্ভব না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও অন্তত ৩ হাজার মেগাওয়াট কমে যাবে। অর্থাৎ লোডশেডিংয়ের চলমান মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা এমন শঙ্কার তথ্য জানিয়েছেন।
বিপিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, আতঙ্কের কিছু নেই। ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে চলতি মাসের ২০ তারিখে একটি জাহাজ দেশে আসবে। আরও ২৫ হাজার টন এ মাসের মধ্যেই আনতে উদ্যোগী বিপিসি। কিন্তু দ্বিতীয় জাহাজটি আনার জন্য সরবরাহকারীদের পাওনা টাকা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ডলার সংকট প্রধান বাধা। অর্থাৎ দ্বিতীয় জাহাজে অয়েল আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
বিপিসি সূত্রের খবর, গতকাল বুধবার পর্যন্ত তাদের কাছে ফার্নেস অয়েলের মজুদ ছিল ২৮ হাজার ৭০০ টন। গড়ে প্রতিদিনের চাহিদা ৩ হাজার ৩৯০ টন। সেই হিসাবে জোগান রয়েছে আর মাত্র ১০ দিনের। বিপিসির ভাষ্য- নিয়মিত সরবরাহের কার্যাদেশ অনুযায়ী চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়বে একটি জাহাজ। পাশাপাশি আরেকটি জাহাজে একই পরিমাণ অয়েল আমদানির চেষ্টাও চলছে।
জ্বালানি সংকটের কারণে দেশে এখন ফার্নেস অয়েলভিত্তিক প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে চলছে উৎপাদন। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বলছেন, পিডিবির কাছে শুধু ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ বিক্রির বিপরীতে বকেয়া জমেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য জ্বালানির প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। বকেয়ার কারণে তারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলার সংকট। জ্বালানির জন্য তাদেরও ভরসা এখন বিপিসি। বিপিসি বলছে, ২০ জুন ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসার কথা রয়েছে। ২৫ জুনের আগে নতুন করে আর তেল আসছে না।
এতদিন শুধু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবির কাছে ফার্নেস অয়েল বিক্রি করত বিপিসি। বেসরকারি কেন্দ্রের মালিকরা নিজেরাই ফার্নেস অয়েল আমদানি করতেন। কিন্তু চলমান ডলার সংকটের জেরে তাদের আমদানি কমে গেছে। ২০ জুন বন্দরে জাহাজ ভিড়লেও বিদ্যুৎকেন্দ্রে সেই তেল পৌঁছতে আরও সপ্তাহখানেক লেগে যাবে।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি এবং সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল খান বলেন, বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস আইপিপিগুলো অর্থ-সংকটে রয়েছে। পিডিবির কাছে গত ছয় মাসের বিল বাবদ ১৮ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে। ব্যাংক ইনস্টলমেন্টগুলো নিয়মিত দিতে পারছে না আইপিপিগুলো। এতে জ্বালানি আমদানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। আইপিপিগুলোর জন্য দ্রুত অর্থছাড়ের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ফার্নেস অয়েল আমদানি এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে এলসি খোলার জন্য আইপিপিগুলোর হাতে নগদ টাকা নেই। অন্যদিকে এলসি খুললেও এসব এলসি নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
বিআইপিপিএর সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, সরকার যদি রেশনিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা হলে বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের যে মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে। আর যদি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হয় তা হলে এ মজুদ দিয়ে সর্বোচ্চ ১০-১২ দিন চলবে। তিনি জানান, বেসরকারি উদ্যোগে নতুন জাহাজ আসার কথা রয়েছে জুলাইয়ের প্রথম দিকে।
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস অয়েল ছাড়াও এলসি খোলার সমস্যার কারণে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় অন্যান্য ধরনের জ্বালানির মজুদও হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম বাজারদরের চেয়ে কম হওয়ায় তারা ঘোষিত দরে বিপিসির জন্য আমদানি এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। চলমান ডলার সংকটকালে সরকার নির্ধারিত হারে অন্য ব্যাংকগুলো যাতে বিপিসিকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করে এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে।
চলতি বছর সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে ৭ লাখ ৬৫ হাজার টনের চাহিদা দেয় পিডিবি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৫৩ হাজার ৫০০ টনের বিপরীতে ৬৯ হাজার ৮৯৭ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ হাজার ৩০০ টনের বিপরীতে ৫৪ হাজার ৪০৬ টন ফার্নেস অয়েল নেয় পিডিবি। অর্থাৎ উল্লিখিত দুই মাসে ২৭ হাজার ৫০৩ টন বেশি নিয়েছে। এর পর ২৩ মার্চ পিডিবিকে নতুন করে চিঠি দিয়ে আগের দুই মাসের সরবরাহকৃত চাহিদার অবশিষ্ট ৬ লাখ ৪০ হাজার টনের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও ২ লাখ ৮০ হাজার টনসহ মোট ৯ লাখ ২০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেয় পিডিবি। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭ মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) জন্য ২ লাখ ৮০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহের চাহিদা দেওয়া হয়।
এতে আইপিপিগুলোর জন্য এপ্রিলে ৭৫ হাজার টন, মে মাসে ৫৫ হাজার টন, জুনে ৫৫ হাজার টন, জুলাইয়ে ৪৫ হাজার টন, আগস্টে ১৫ হাজার টন, সেপ্টেম্বরে ২০ হাজার টন এবং অক্টোবরে ১৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়। পাশাপাশি এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ৬ লাখ ৪০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে অনুরোধ করে পিডিবি।
পিডিবির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে পিডিবির চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের আমদানির পাশাপাশি ১০-২০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিয়ে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকেন। ওই শর্ত অনুযায়ী, ১০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে সরবরাহের প্রয়োজন হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশে ডলারের সংকট এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এলসি খোলায় অনীহার কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজ দায়িত্বে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না। তাই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি সংকটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসওয়ারি চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য বিপিসিকে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
অন্যদিকে আমদানি সুবিধা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এর পর আইপিপিগুলোতে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিপিসি। আইপিপিগুলোকে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও শর্ত ছিল ১০-২০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকায় চুক্তির শর্ত মোতাবেক ১০-২০ শতাংশ জ্বালানি বিপিসি থেকে নেওয়া হতো না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আইপিপিগুলো শর্তটি কাজে লাগাতে শুরু করে; পিডিবির মাধ্যমে বিপিসি থেকে নেওয়া শুরু করে ফার্নেস অয়েল।
জানা গেছে, মার্চে পিডিবির দেওয়া চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহে ব্যর্থ হয় বিপিসি। এ ছাড়া জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানির কোনো চালান দেশে আসছে না। এতে ফার্নেস অয়েলের মজুদও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, এপ্রিলে এক লাখ ৪০ হাজার টন এবং মে মাসে এক লাখ ৩০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল পিডিবির। এর মধ্যে মে মাসে বিপিসি সরবরাহ করেছে প্রায় ৭৬ হাজার টন, চলতি মাসে অর্থাৎ জুনে এক লাখ ২০ হাজার টন এবং জুলাইয়ে এক লাখ ১০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে পিডিবির। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে বিপিসির।