দেশজুড়ে যখন দাবদাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন সপ্তাহখানেক ধরে বিদ্যুতের লোডশেডিংও ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গড়ে প্রতিদিন ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে রাজধানী ও আশপাশের শহরগুলোয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। যেসব ভবনে জেনারেটর আছে, সে সব ভবনের বাসিন্দারা লোডশেডিংকালে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও সাধারণ মানুষের বিপর্যস্ত দশা। বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘœ হওয়ায় ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওয়াসাই শুধু নয়, নিজস্ব ব্যবস্থায় ভূর্গভস্থ পানি উত্তোলন করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই সংকটে পড়েছে। একদিকে গরম, অন্যদিকে বিদ্যুৎবিভ্রাটে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। এ দুয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে পানির সংকট। সব মিলিয়ে ভীষণ অস্বস্তিতে আছে মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাপপ্রবাহ না কমলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। এছাড়া ডলার সংকটে সৃষ্ট জ্বালানির জোগান-সংকট থেকে উত্তরণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তারা বলছেন, আরও কয়েক মাস বিদ্যুৎ সংকটের মধ্য দিয়েই যেতে হবে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়েও স্বীকার করেছেন, বর্তমানে লোডশেডিং পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এর পরই তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা জ্বালানি জোগানের চেষ্টা করছি। আশা করছি, লোডশেডিং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দুই সপ্তাহ লাগবে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা ও তেলের জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে লোডশেডিং বেড়ে গেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কত দ্রুত কয়লা নিয়ে আসা যায়, তার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সক্ষমতার
অর্ধেক চলছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক চালু। জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোরও একই অবস্থা। এর দ্রুত সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগ চেষ্টা করছে। তবে গত বছরের জুলাইয়ের মতো শিডিউল লোডশেডিংয়ের ভাবনা আপাতত সরকারের নেই, জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, তাপপ্রবাহ চলছে, তাই বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি আছে। দুই মাস আগে থেকেই চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু জ্বালানি আসার পেছনের বিষয় সব সময় তাদের হাতে থাকে না। অর্থনৈতিক বিষয়, জ¦ালানি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার বিষয় থাকে; সব সমন্বয় করতে হয়। সমন্বয় কোথাও বাধাগ্রস্ত হলেই সমস্যা হয়। এবারও তাই হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ সারাদেশে সন্তোষজনক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো তৈরি করেছে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের বিষয়টি নির্ভর করছে জ্বালানির জোগানের ওপর। কয়লা, গ্যাস বা তেলের জোগান পুরোপুরি বিদ্যুৎ-জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে না। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা বরাদ্দপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে। এছাড়া অনেক সময় অর্থের বরাদ্দ পেলেও হয় না। যেমন- এখন ডলার সংকট চলার কারণে এলসি খুলতে ডলারের জোগান নিশ্চিত করতে হয়। ফলে পুরো বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে আছে। এ কর্মকর্তা বলেন, পায়রার জন্য কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। সেটা এলে হয়তো সাময়িক সংকট দূর হবে। কিন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য অব্যাহত জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমার ধারণা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বা বিশ^ব্যাপী যে অস্থিরতা চলছে সেটা শেষ না হলে নানা সংকটের মধ্যদিয়েই যাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানির জোগান আগামীতে সত্যি বড় চ্যালেঞ্জ।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে লোডশেডিং ছিল দুই হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট। উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হয়েছে ২০৬৭ মেগাওয়াট। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হয়েছে এক হাজার ৯৯২ মেগাওয়াট। পানি বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদন হয়েছে ২৫ মেগাওয়াট, সোলার থেকে উৎপাদন হয়েছে ৩৬৬ মেগাওয়াট, বায়ু বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদন হয়েছে ৫ মেগাওয়াট। এছাড়া ভেড়ামারা দিয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হয়েছে ৯২৪ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ এসেছে ১৫৪ মেগাওয়াট। এছাড়া বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ভারতে আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ড বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় সাড়ে সাতশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যেই পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল নেই বলে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তেজগাঁওয়ের দিকে কয়েকটি পেট্রোল পাম্পে তেল পাওয়া যাচ্ছে না- এমন গুজবের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, তেলের কোনো সংকট নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে ফার্নেস অয়েল দিয়ে। আর গাড়ি চলে ডিজেল বা অকটেন দিয়ে। ফলে তেল পাওয়া যাচ্ছে না- এগুলো নিতান্তই গুজব।
এ বিষয়ে পেট্রোল পাম্প অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেলের কোনো সংকট নেই। তবে শুক্র ও শনিবার দুই দিন তেলের ডিপো থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ রাখার কারণে অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো পেট্রোল পাম্প হয়তো তেল উত্তোলন করতে পারেনি। এ কারণে তেল নাও থাকতে পারে। তবে তেলের কোনো সংকট নেই।
এদিকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানিতে সংকট তৈরি হলে কিংবা পায়রার মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে, তেমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ কীভাবে সামাল দেওয়া হবে? এমন প্রশ্নে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, সামগ্রিকভাবে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে এখন বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে আসছে। তিনি বলেন, বরিশাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, এস আলমের বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আপাতত এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক আছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। ফলে লোডশেডিং কিছুটা বাড়লেও বড় কোনো সংকট হবে বলে মনে করছি না। তিনি বলেন, এখন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি চালু রাখতে হবে। এছাড়া তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশের সবচেয়ে বড় এবং সাশ্রয়ী পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এ কেন্দ্রের একটি ইউনিট গত ২৫ এপ্রিল বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লা সংকটে দ্বিতীয় ইউনিটও আজ (সোমবার) বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্যাস সংকটে গ্যাসভিত্তিক প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ডলার সংকটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) স্বাভাবিক তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা সরকারের কাছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাবে, ফলে তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে তাদের মধ্যেও ধীরগতি বিরাজ করছে। এসব কারণে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়ছে।