জাতীয় বাজেট ঘোষণার আর মাত্র একদিন বাকি। আগামী বৃহস্পতিবার ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। যদিও কিছু পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাবের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম করা হয়েছে, ‘উন্নয়নের দেড় দশক : স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ বাজেট বক্তৃতায় মোট অধ্যায় রয়েছে ১১টি। পুরো বাজেট বক্তৃতাজুড়ে সরকারের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরা হবে।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের কলম, গৃহস্থালি সামগ্রী, বিমান ভাড়া, ভ্রমণ কর, মোবাইল ফোন সেটসহ বেশকিছু পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি এবং গাড়ির কার্বন সারচার্জ যুক্ত করার প্রস্তাব থাকতে পারে বাজেটে। আবার বাড়তি আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় ও ভর্তুকি কমানোসহ আইএমএফের বেশকিছু শর্ত বাস্তবায়নের প্রতিফলন থাকবে বাজেটে। ফলে আসছে অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা বাড়বে, যাতে সরকারের পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জিং হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট এটি। এমন এক সময়ে এসে এই বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে, যখন খাদ্য থেকে জ্বালানি ও পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে সেবা খাতের বিল পর্যন্ত- প্রায় সবকিছুরই উচ্চমূল্যের সঙ্গে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। ফলে উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারস্থ সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্তপূরণের প্রতিফলন থাকছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করার ঘোষণা থাকবে। ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসা নিজের মতো বাজেটে প্রণয়নের ধারায় হোঁচট খাবে সরকার।
আইএমএফের ঋণের একটা অংশ আসছে লেনদেনের ভারসাম্য বজায়ের সহায়তা হিসেবে। ঋণের প্রথম কিস্তি মাত্র পাওয়া গেছে। সংস্কারের পদক্ষেপ না থাকলে আটকে যাবে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া। তাতে চলমান ডলার-সংকট আরও বড় আকারে দেখা দেবে। তবে আইএমএফ সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কর্মসূচির কারণে আগামী অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা বাড়বে।
জানা গেছে, বাচ্চার কলম, গৃহিণীর অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের ঘটিবাটি, টয়লেট টিস্যু-ফেসিয়াল টিস্যু, নতুন মোবাইল ফোন কেনা- সব খাতেই খরচ বাড়বে। ঘুরতে বা চিকিৎসা করাতে বিদেশ যেতে চাইলে বিমান টিকিটের সঙ্গে বাড়তি ভ্রমণ কর দিতে হবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য খেজুর, কাজুবাদাম খান অনেকে- এ দুটি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোয় দাম বাড়তে পারে। আবার করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
জানা গেছে, কলম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে কলমের দাম বাড়তে পারে। প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। একইভাবে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালিসামগ্রী ও তৈজষপত্রের ভ্যাট হার বাড়ানো হচ্ছে। সব ধরনের টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে টিস্যু পেপারের দাম বাড়তে পারে। মোবাইল ফোন উৎপাদন পর্যায়ে ২ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। আর সংযোজন পর্যায়ে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।
বিদেশ ভ্রমণ অথবা চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের খরচ বাড়বে। বাজেটে বিমান টিকিটের ওপর ভ্রমণ কর বাড়ানো হচ্ছে। আকাশপথে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে, এতদিন দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ কর দিতে হতো না। বর্তমানে স্থলপথে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ও নৌপথে ৮০০ টাকা কর বহাল রয়েছে, এটি বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে এক হাজার ২০০ টাকা কর আছে, এটি বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হচ্ছে।
অন্য দেশ ভ্রমণে তিন হাজার টাকা কর আছে, এটি চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আকাশপথে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও তাইওয়ান ভ্রমণে যাত্রীপ্রতি চার হাজার টাকা ভ্রমণ কর আছে, এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হচ্ছে।
নিম্নআয়ের মানুষকে কর-জালের মধ্যে আনার ছকও থাকছে বাজেটে। কারণ শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেওয়া গেলেও আগামীতে সিøপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। না হলে সঞ্চয়পত্র ক্রয় ও ব্যাংকঋণ, ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না।
বর্তমানে একাধিক গাড়ি রেজিস্ট্রেশন বা ফিটনেস নবায়নে দ্বিতীয় গাড়ির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বাড়তি অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। এর সঙ্গে কার্বন সারচার্জ যুক্ত হতে যাচ্ছে। ১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির জন্য ২৫ হাজার টাকা, ১৫০০ সিসি (৭৫ কিলোওয়াট) থেকে ২০০০ সিসির (১০০ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ সিসি (১০০ কিলোওয়াট) থেকে ২৫০০ সিসির (১২৫ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি (১২৫ কিলোওয়াট) থেকে ৩০০০ সিসির (১৫০ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩০০০ সিসি (১৫০ কিলোওয়াট) থেকে ৩৫০০ সিসির (১৭৫ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য দুই লাখ টাকা এবং ৩৫০০ সিসি (১৭৫ কিলোওয়াট) বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা কার্বন সারচার্জ দিতে হবে।
বাজেটের আকার : অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের জন্য রেকর্ড ব্যাংক ঋণনির্ভর বাজেট প্রণয়ন চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এই বাজেটের ঘাটতিই ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে ঘাটতি পরিমাণ পাঁচ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশাল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ (নিট) নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে যার পরিমাণ ছিল এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে সাত দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে একই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ছয় দশমিক শূন্য তিন শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আর মোট জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে পঞ্চাশ লাখ ছয় হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছিল ৪৪ লাখ ৪৯ কোটি ৯৫৯ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয়। বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে সাত দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে জন্য মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব খাতবহির্ভূত (নন-এনবিআর) থেকে আয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় থাকবে এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা (৬৪.২৬ শতাংশ) এবং বিদেশি প্রকল্প সাহায্য হিসেবে আসবে ৯৪ হাজার কোটি টাকা (৩৫.৭৪ শতাংশ)।
বাজেটে বিদেশ থেকে একটি বিশাল অংকের ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে আগামী বাজেটে বিকেুশ নিট ঋণপ্রাপ্তি ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর বাইরে অনুদান হিসেবে আরও আসবে তিন হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের নিট লক্ষ্য ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণপ্রাপ্তির প্রস্তাব করা হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা, যদিও চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে।
অন্যদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর বার্তা দেশবাসীর কাছে পৌঁছাতে চায় সরকার। সেজন্যই কর্তৃপক্ষ গঠনসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকা সত্ত্বে¡ও জুলাই থেকে পাইলটিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাজেট বক্তব্যে এ বিষয়ে ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।