দেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পরস্পরবিরোধী এ দুই দলের রাজনীতি দুই মেরুর। এ দুই মেরুরই এতদিন ধরে চলে আসা হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর। আর সেই পাল্টে যাওয়ার পালে জোর হাওয়া দিয়েছে গাজীপুর সিটি নির্বাচন এবং এর ফল।
নতুন ভিসানীতির ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের মার্কিন ভিসা দেওয়া হবে না। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভিসা দেওয়া হবে না। এ ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকেই প্রভাবিত করেনি, তোলপাড় সৃষ্টি করেছে দেশজুড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান যে প্রশ্নবিদ্ধ, মার্কিন ভিসানীতির ঘোষণা সেই বার্তাই দেয়। অন্যদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর পরাজয়ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য আরেকটি বার্তা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে গত এক বছর ধরে বিএনপির আন্দোলনের প্রধান দফা ছিল, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। দলটির ভাষ্য, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল বিএনপির। কিন্তু সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় এবং এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতায় নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে বিএনপির।
গত ২৪ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজ দেশের ভিসানীতি প্রকাশ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা বাধা দেবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না। সোস্যাল মিডিয়ায় রাতভর মার্কিন নীতি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ২৫ মে অনুষ্ঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি সুষ্ঠু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। তারা বলছেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, নিরাপত্তা বাহিনী সবার ‘আন্তরিকতায়’ ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। একই দিন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। দলগুলোর পক্ষ থেকে নতুন মার্কিন ভিসানীতিতে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের নির্বাচনে ‘স্বচ্ছতা প্রমাণ’ করে ক্ষমতাসীন দল বোঝাতে চেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। ফলে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভিন্ন ভাবনার আশ্রয় নিতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। বিশিষ্টজনরা বলছেন, মার্কিন ভিসানীতি ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন আগামীর রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘আমেরিকার ভিসানীতি শুধু ভিসানীতি নয়, ক্ষেত্রবিশেষে অঙুলি প্রদর্শনও। ফলে এ বিষয়ে সব দলকে ভাবতে হবে এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ এই অঙুলি প্রদর্শন শুধু আওয়ামী লীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘গাজীপুরের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তবে এটা কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন
হয়নি। কারণ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থী ছিল না এবং ভোটারদের হাতে বিকল্প ছিল না। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায় না।’
এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার পেছনে মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব ছিল বলে মনে করেন সুজন সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘যে কোনো যৌক্তিক মানুষ, মাশুল দেওয়ার ভয়ে থাকলে অপকর্ম থেকে দূরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, এই নির্বাচন সরকারি দলের জন্য একটা বার্তা দিয়ে গেছে। কারণ সুযোগ পেলেই মানুষ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রতিফলন দেখাচ্ছে।’
এদিকে, গতকাল শুক্রবার বিকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তিনি বলেন, ‘আগামীতে আরও চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন একইভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে।’
নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশা অনুযায়ী গাজীপুরে ভোট হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘এই ভোট নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা জোরালো করবে। এখানে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করেছে। মানুষের ভোটের স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে।’ ‘এই নির্বাচনের ভুলগুলো আওয়ামী লীগ শুধরে নেবে,’ যোগ করেন তিনি।
তবে এই নির্বাচনে মার্কিন ভিসানীতির কোনো প্রভাব আছে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘দেশে এবং দেশের বাইরে নানারকম সমালোচনার মধ্যে সরকার দেখাতে চেয়েছে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম এবং তারা সেটার প্রমাণ দিয়েছে। কৌশলগত দিক থেকেও তারা সফল। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার চেয়েছে হস্তক্ষেপ চায়নি, সে জন্যই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখেছি।’ স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক না উল্লেখ করে শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন কমিশন যেভাবে করেছে তা জাতীয় নির্বাচনে সম্ভব কিনা- তা ভেবে দেখতে হবে।’
তবে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে ভিন্ন ভাবনা ভাবছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সমন্বয়ক মির্জা আজম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় যেসব ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা বাছাই করা হয়, তাদের ওপর ভরসা রাখছিলেন প্রার্থী আজমত উল্লা খান। এই বিশ^াসটাই ভুল হয়েছে বলে মনে করেন মির্জা আজম। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ড পর্যায়ের কিছু নেতা বিশ^াসঘাতকতা করেছে। যার ফলেই ভোটের এই ব্যবধান। আওয়ামী লীগের জন্য শিক্ষণীয় যে, যারা বিশ^াস ভঙ্গ করে তাদের ওপর আস্থা রাখতে নেই।’
গাজীপুরের নির্বাচনে মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব প্রসঙ্গে মির্জা আজম বলেন, আমেরিকা ভিসানীতি তো দিয়েছে বিএনপির জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য নয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করবে, বর্জন করবে, প্রতিরোধ করবে। নির্বাচনে যারা বাধা দেবে, তাদের বিরুদ্ধেই এই ভিসানীতি। আওয়ামী লীগ ভালো নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারা কোন বার্তা পেয়েছে জানতে চাইলে প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ঐক্য ঐক্য এবং ঐক্য। ভোটে বিজয়ী হতে হলে দলীয় ঐক্যের বিকল্প দেখি না।’