বিদেশি বিনিয়োগেও খরা: নয় মাসে কমল ১৮ শতাংশ সামনে আরও কমার আশঙ্কা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পালে হাওয়া লাগলেও এখন অর্থনীতির এই সূচকেও খরা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম আট মাস পর্যন্ত এই সূচকটি ইতিবাচক ধারায় ছিল। শুধু নিট এফডিআই নয়, পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগেও (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) দৈন্যদশা চলছে।

অর্থনীতিবিদরা এই পরিস্থিতির জন্য চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সৃষ্ট অনিশ্চয়তার পাশাপাশি দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাবকে দায়ী করছেন। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সামনের দিনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বই কঠিন সময় পার করছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। আমাদের প্রবাসী আয় নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। রপ্তানি অর্ডার কমে গেছে। দেশ থেকে অর্থপাচারও বেড়েছে। এই অবস্থায় ডলারের সংকট ও দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এতে প্রায় সব পণ্যের এলসি কমে গেছে। এর মানে নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। আর দেশি বিনিয়োগ কমে গেলে বিদেশি বিনিয়োগেও তার প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া আগামী বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সব মিলে সামনের দিনগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এগুলো হলো- উচ্চ শুল্ক-অশুল্ক বাধা, অবকাঠামোসহ উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা এবং আস্থার সংকট। গত মার্চে দাতা সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কোনো দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে একটি সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবেশ পূর্বশর্ত; যা বৈদেশিক বাণিজ্যকে প্রসারিত করে। একই সঙ্গে এফডিআই আকর্ষণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পরিবেশ উপযুক্ত নয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগই তুলনামূলক কম উপযুক্ত। একইভাবে এখানে উচ্চ শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে, যেগুলো হ্রাস করা খুবই জরুরি।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত এক দশক ধরে অবকাঠামো খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও উপযুক্ত অবকাঠামো এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ও পুঁজির অনিশ্চয়তা। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে ভোগেন বলে মনে করে আইএমএফ।

দেশে মহামারী করোনার আঘাত আসে ২০২০ সালের মার্চে। তার আগেই চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশ আক্রান্ত হয়। এতে বিশ্বজুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে। বাংলাদেশেও নিট এফডিআইয়ে ধাক্কা আসে। ২০২০ সালে নিট এফডিআই কমে যায় ১০ শতাংশেরও বেশি। ওই বছরে দেশে নিট এফডিআই আসে ২৫৬ কোটি ডলার। তবে করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করায় ২০২১ সালে নিট এফডিআই ইতিবাচক ধারায় ফিরে। ওই বছরে নিট এফডিআই আসে ২৮৯ কোটি ডলার, এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি ছিল। গত বছর নিট এফডিআইয়ের গতি আরও ইতিবাচক ধারায় ফিরে। পুরো বছরে নিট এফডিআই এসেছে ৩৪৭ কোটি ডলার। এটি তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি ছিল। তবে চলতি বছরে এসে নিট এফডিআইয়ের গতি আবার ধীর হয়ে আসে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা ইতিবাচক ধারায় থাকলেও মার্চ নেতিবাচক ধারায় নেমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে নিট এফডিআই এমেছে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে নিট এফডিআই এসেছিল ১৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুরোর মুনাফার অর্থ তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই নয় মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) আসে, চলে গেছে তার চেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে পুঁজিবাজারে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার থেকে ৪ লাখ ডলার বেশি চলে গেছে।

আমদানিতে কড়াকড়ি, ডলার সংকটে বৈদেশিক বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় গত কয়েক মাস ধরে দেশি বিনিয়োগেও ধীরগতি এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ২২৯ কোটি ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অন্যদিকে এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ৭৫১ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। এ ছাড়া গত চার মাস ধরে বেসরকারি খাতের ঋণেও ধীরগতি চলছে। সর্বশেষ মার্চ মাসে এ খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছরের অন্য মাসগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *