বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের দিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা যত এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং টেকনাফ উপকূলের মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
শনিবার দুপুরের পর থেকেই সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে শুরু করেছেন।
সেখানকার বহুতল হাসপাতাল, সাইক্লোন সেন্টার ও গেস্ট হাউজের পাশাপাশি বহুতল রিসোর্টগুলোকেও আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
টেকনাফের হালকা, ভঙ্গুর বাড়িঘরগুলোর বাসিন্দাদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
তবে টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ১২ লাখের বেশি মানুষকে আপাতত ক্যাম্পেই রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রোববার বিকেল নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
বিচ্ছিন্ন সেন্টমার্টিনে ভয়ের পরিবেশ
ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসার সাথে সাথে দ্বীপের বিভিন্ন বহুতল ভবনে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ।
‘’মানুষজন আশ্রয় শিবিরের দিকে যাচ্ছে। যেখানে পারছে, উঠে পড়ছে। দ্বীপে দোতলা-তিনতলা যেসব ভবন আছে, রিসোর্ট আছে, সবগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষজন সেখানে উঠতে পারে,’’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন চেয়ারম্যান নুর আহমদ।
শুক্রবার দুপুর থেকেই সেন্ট মার্টিনের সাথে টেকনাফের নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগে দেড় থেকে ২ হাজার মানুষ এসে টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের হাসপাতালের পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আজিজ। সেখান থেকে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, দ্বীপে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসও কমে গেছে।
“ঝড় কখন চলে আসে, সেই ভয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে এসেছি। দ্বীপে অন্য যারা আছে, তারাও সবাই বিভিন্ন কেন্দ্রে যাচ্ছে” – বলেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “সেন্ট মার্টিনে যে সমস্ত সরকারি স্থাপনা, যেগুলো শক্ত, মজবুত, দু-তলা, তিনতলা – এরকম ৩৭টা স্থাপনা আমরা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছি। ওখানে ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
দ্বীপে যেসব দ্বিতল বা তিনতলা আবাসিক হোটেল বা রিসোর্ট রয়েছে, সেগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র বলে ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
এরকম একটি হোটেল ব্লু মেরিনের ব্যবস্থাপক মনসুর আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’আমাদের দোতলা আর তিনতলায় ৫০০-এর বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সবগুলো রুমই খুলে দেয়া হয়েছে। মহিলা আর শিশুরা কক্ষগুলোয় রয়েছে, আর পুরুষরা থাকছে বাইরে।‘’
দ্বীপে এখন কোনো পর্যটক নেই বলেও তিনি জানিয়েছেন।
জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় থাকার জন্য দোতলা আর তিনতলাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যারা আশ্রয় শিবিরে উঠছেন, তারা দোতলা বা ওপরের দিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
তবে হোটেলের ব্যবস্থাপকরা জানাচ্ছেন, অনেকেই নিচতলায় থাকার জন্যও অনুরোধ করছেন। তারা বলছেন, জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে তখন ওপরে উঠে আসবেন। দ্বীপে এতো মানুষের থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা নীচতলাগুলোও খুলে দিচ্ছেন।
সানরাইজ হোটেলের ম্যানেজার মো: ইসহাক বলছেন, ‘’আমাদের হোটেলে ১৭০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সবগুলো রুমই দ্বীপের মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। আরো মানুষজন আসছে।‘’
কিন্তু অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় থেকে এসব আশ্রয় কেন্দ্র কতটা নিরাপদ হবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যেও সন্দেহ রয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘’আমাদের এসব হোটেলের ফাউন্ডেশন তো বেশি শক্ত না। দ্বীপের একটা সাইক্লোন সেন্টার আর হাসপাতাল ভবন ছাড়া আর অন্যসবগুলো ভবন বেশি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় কতটা ঠেকাতে পারবে, সন্দেহ আছে। বাধ্য হয়ে আমরা এখানে থাকলেও ভয়ও কাজ করছে।‘’
স্থানীয় একজন বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম নিজেও পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দ্বীপের মানুষজন নানা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শুরু করেছেন।
সবার সাথেই শুকনো খাবার ও পানি রয়েছে। সবাই চেষ্টা করছেন, দ্বীপের পূর্ব দিকের ভবনগুলোয় আশ্রয় নেয়ার জন্য।
তবে সীমিত এসব ভবনে দ্বীপের বারো হাজার মানুষের সবার জন্য নিরাপদ আশ্রয় হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রামের একজন স্বেচ্ছাসেবী আবদুল শুক্কুর শনিবার সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দ্বীপের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় চলে যাওয়ার জন্য শুক্রবার এবং শনিবার মাইকিং করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এর মধ্যেই দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নানা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছে। বাকিরাও আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, দ্বীপে এখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে কিছু দোকানপাট খোলা থাকলেও উপকূলের কাছাকাছি এবং দূরের দোকানপাটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা মহেশখালীতে
বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
কক্সবাজার থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানাচ্ছেন, ঝড়ের প্রভাবে সেখানে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নাজুক এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
‘’সবাইকে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার কাজ করছি। আমরা চাই না ঝড়ে কোনরকম প্রাণহানির ঘটনা ঘটুক,’’ তিনি বলছেন।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপকূলের কাছাকাছি যেসব জেলেরা বসবাস করেন, তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যার মধ্যেই সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা করছিল কর্তৃপক্ষ।
তবে ঝড়ের এগিয়ে আসার সাথে সাথে কক্সবাজারের মহেশখালীর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
সেখানকার বাসিন্দা বশীর উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, মহেশখালীতে ৮টি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভাঙা, এবং সেদিক দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে পড়তে পারে এমন শঙ্কায় আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদের একজন বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’সবাইকে নিয়ে স্কুল ঘরে আশ্রয় নিছি। গরু ছাগল নিচে বাইন্ধা রাখছি, কিন্তু পানি ঢুকলে তো সেগুলো বাঁচবে না, এ নিয়ে চিন্তায় আছি।‘’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জানান মোট ৫৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত আছে, যেখানে ৫ লাখের উপর মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এর বাইরে স্কুল, কলেজ ও কয়েকটি হোটেল-মোটেল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝড়ের প্রস্তুতি
কক্সবাজারের উখিয়া আর টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। ত্রিপল, বাঁশ, কাঠ দিয়ে তাদের ঘরগুলো তৈরি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে সেগুলো টিকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সতর্ক করে নানারকম প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে যারা পাহাড়ি ঢাল বা পাদদেশে বসবাস করে, তাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে মাইকিং করা হচ্ছে।
উখিয়ার একজন রোহিঙ্গা মোঃ সলিম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’ঝড়ে তো আমাদের এই ঘর টিকবে না। কিন্তু আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।‘’
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শনিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘’ঘূর্ণিঝড় মোখা যদি মিয়ানমারের বদলে বাংলাদেশ আঘাত হানে, তাহলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে। কিন্তু দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে কাঁটাতারের বেড়া ক্রস করে বের হতে না পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে।‘’
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আলাদা বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, খাবার ও পানি সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসার প্রস্তুতিসহ স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি রাখা হয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শামছু-দ্দৌজা বিবিসিকে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তারা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে মিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়া খুব সহজ কোনো কাজ হবে না বলেই তিনি বলছেন।
‘’লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া খুব কঠিন একটা ব্যাপার, এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবে, এটাই বাস্তবতা,’’ তিনি বলছেন।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘’আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে প্রাণহানি এড়ানো। বিশেষ করে ঝড়ের পরের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার প্রতিও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। অতি বৃষ্টির কারণে হঠাৎ বন্যা বা ভূমিধ্বসের ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে।‘’ সূত্র : বিবিসি