ব্যাংক খাতে চলা তারল্য সংকটের মধ্যেও বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক তাদের সংগৃহীত আমানতের শতভাগেরও বেশি ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের এহেন আগ্রাসী কার্যক্রম তারল্য সংকট আরও বাড়ানোর পাশাপাশি আমানতকারীদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে। এমতাবস্থায় চলতি মে মাসের মধ্যেই ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগ (বিতরণকৃত ঋণ) নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদ্যমান নিয়মে, প্রচলিত ধারার ব্যাংক সংগৃহীত আমানতের সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯২ শতাংশ ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে পারে। কিন্তু গত মার্চ মাস পর্যন্ত করা হিসাবে বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণ ও আমানতের অনুপাতে (এডিআর/আইডিআর) সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬টি ইসলামী ব্যাংক; ৫টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক। এ সময়ে ৩টি ইসলামী ব্যাংকের এডিআরে সেঞ্চুরি হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে তাদের আমানতের চেয়েও বেশি। সঙ্গত কারণেই এসব ব্যাংকের তারল্য সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্চ পর্যন্ত করা হিসাবে যে ১১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার বাইরে ছিল সেগুলো হলোÑ ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের আগ্রাসী কার্যক্রমই তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। কারণ ১০০ টাকার আমানতের পুরোটা কোনোভাবেই ঋণ হিসেবে দেওয়ার সুযোগ নেই। এই ১০০ টাকার মধ্যে সিআরআর ও এসএলআর হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হবে। এটা বাদে ঋণ দেওয়ার যে সীমা নির্ধারিত আছে, সেটা যদি অতিক্রম হয়, তা হলে বাকি টাকা হয়তো মানি মার্কেট থেকে ধার করে বিতরণ করা হয়েছে।
আর মানি মার্কেটের ধার করা অর্থ যদি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ হয়ে থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তারল্যের অসামঞ্জস্য আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এটাই আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে প্রত্যেকটি ব্যাংকের উচিত ঋণ-শৃঙ্খলা মেনে চলা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোর হতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারীর আগে ব্যাংক খাতে নির্ধারিত সীমায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর পরও অনেক ব্যাংক তা সমন্বয় করতে পারেনি।
সে সময় করোনার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনা ও ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০২০ সালের এপ্রিলে এডিআর দুই শতাংশ বাড়িয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ ও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৯২ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর এ সীমায় কোনো পরিবর্তন আনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্রগুলো বলছে, এডিআর বাড়ানোর পরও সে সময় বেশ কিছু ব্যাংকের ঋণ ছিল বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়েও বেশি। করোনা মহামারীর পর আগ্রাসী ঋণ বিতরণের কারণে নতুন করে কয়েকটি ব্যাংকের এডিআর সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বাইরেও ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি, সার্বিক তারল্য পরিস্থিতিসহ অন্যান্য আর্থিক সূচক বিবেচনায় নিয়ে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে। কাজেই ঘুরেফিরে এডিআর সীমা লঙ্ঘন করার তালিকায় যেসব ব্যাংকের নাম আসছে তাদের সবার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে সীমা লঙ্ঘন নাও হতে পারে। তবে কয়েকটি ব্যাংকের এডিআর যে সীমার বাইরে রয়েছে তা সত্যি। এরই মধ্যে তাদের এডিআর সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এডিআর সীমা লঙ্ঘন করা ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনাÑ এমন প্রশ্নে মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকগুলোর এডিআর অনুপাত বিভিন্ন সময় ওঠানামা করে। তবে দীর্ঘদিন কোনো ব্যাংকের এডিআর সীমার বাইরে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে অবশ্যই চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। আবার অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত মার্চে এডিআর সীমা লঙ্ঘনে সবার শীর্ষে ছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির এডিআর সীমা উঠেছে রেকর্ড ১০৬ দশমিক ১২ শতাংশে। এডিআর সীমা লঙ্ঘনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। এ ব্যাংকের এডিআর সীমা ১০০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এডিআর ১০০ দশমিক ০৩ শতাংশ। এ ছাড়া এবি ব্যাংকের ৯৯ দশমিক ৬০ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকের ৯৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৮৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ঢাকা ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ০৩ শতাংশ এডিআর রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকা ব্যাংক ও এবি ব্যাংকে ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারির স্থিতির ভিত্তিতে আগামী ৩১ মের মধ্যে এডিআর নির্দেশিত সীমায় নামিয়ে আনতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে গত মাসে চিঠি দিয়ে এডিআর নির্দেশিত সীমায় নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে অফসোর ব্যাংকিং অপারেশন (ওবিও) ব্যতীত এডিআর নির্দেশিত সীমায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ান ব্যাংকে এডিআর নির্দেশিত সীমায় নামিয়ে আনতে গত সপ্তাহে চিঠি দেওয়া হয়েছে।