বাংলাদেশ সময় গতকাল ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। আর এর উৎপত্তিস্থল ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ পূর্বে; ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া না গেলেও যাচ্ছেতাইভাবে গড়ে ওঠা অসংখ্য ভবনের এই ঢাকা নগরীর জন্য এ এক সতর্কবার্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোটি মানুষ অধ্যুষিত এ শহরকে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে হলে সময় থাকতেই সাবধান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় উদ্যোগী হতে হবে। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে সরকারের। এ ছাড়া নীতিনির্ধারণী কর্মকা-, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকি এবং মানুষের সচেতনতাই পারে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে।
রাজধানী ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সমীক্ষাটি চার বছর (২০১৮ থেকে ২০২২ সাল) ধরে করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে। সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। অন্যদিকে সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (ভূতত্ত্ব) উপপরিচালক আক্তারুল আহসান বলেন, ছোট ভূমিকম্প আমাদের বড় ভূমিকম্পের একটা সংকেত দিয়ে গেল। আমরা আগে থেকে বলে আসছি ঢাকা এবং আশপাশের অঞ্চলগুলো যে বড় ঝুঁকিতে আছে তার একটি ছোট প্রমাণ পাওয়া গেল। ঢাকার আশপাশে থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে যেকোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্প হতে পারে। তিনি বলেন, ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ডে এই অঞ্চলগুলোতে ছোট আকারের কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। আর আমাদের এই অংশে যেহেতু হচ্ছে না তাই আমরা ধরে নিচ্ছি এই অংশে শক্তিটা জমা হয়ে আছে। জমা হতে হতে যখন এটা আর শক্তি ধরে রাখতে পারবে না তখন এটা বড় আকারের একটা ভূমিকম্প হয়ে প্রকাশ পাবে। অথবা ছোট ছোট কয়েক হাজার ভূমিকম্প হতে পারে। তবে আমরা যেসব ডাটা বিশ্লেষণ করেছি তাতে জানা গেছে, যে শক্তিটা জমা আছে তাতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বাংলাদেশে অনেক বড় ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা আছে। যেখান থেকে যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আগে সাধারণত এ ধরনের ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যেকোনো সময়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে- এমন আশঙ্কা করছেন তারা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচন্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলটির বিস্তার প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির অবস্থানের কারণে এ এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা এসব এলাকা অবশ্য ঢাকা থেকে ন্যূনতম ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মাকসুদ কামাল আমাদের সময়কে বলেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার দোহার
থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ পূর্বে দোহার বড় খাল নামকস্থানে। আমরা ধারণা করছি, এই খালটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যাকে ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা বলে। এ রকম বাংলাদেশে অসংখ্য ছোট ছোট ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি আছে। যেগুলো থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নেই। ছোট ছোট চ্যুতি থেকে যখন ভূমিকম্প হয় সেগুলোর মাত্রা বেশি হয় না। যেমন আজকের (গতকাল) ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। তবে এ থেকে পরিস্কার যে, আমাদের দেশের এ অঞ্চলটি ভূতাত্ত্বিকভাবেই ভূমিকম্পপ্রবণ। আর বাংলাদেশে অনেক বড় ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখাও আছে। যেখান থেকে যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ জন্য আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের এই শিক্ষক আরও বলেন, আমার গবেষণা অনুযায়ী, এমন ভূমিকম্প দেশে আগেও হয়েছে। সাধারণত নদীপথ নিয়ন্ত্রণ করে যে ফাটলরেখা, তা দিয়ে যখন ভূমিকম্প হয়, সেই ভূমিকম্প বড় হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ অঞ্চলে দুটি বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে। তার একটি ১৯১৮ সালে, শ্রীমঙ্গলে। আরেকটি হয় ১৮৮৫ সালে, ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে। এটিকে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ বলা হয়। আমাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল পুরোটাই ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে এই অঞ্চলে।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, আমাদের এই অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এখানে ভূমিকম্প হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দোহারে কেন হলো, তা বলা মুশকিল। আমাদের দেশে মোটামুটি ৫টি ফল্টলাইন আছে। কোনো স্থানে ভূমিকম্পনের জন্য ফল্টলাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খন্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্টলাইন বলা হয়। ফল্টলাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশের মূল ভূভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এ রকম কয়েকটি ফল্টলাইন রয়েছে বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ছোট ভূমিকম্পের মানে হচ্ছে- সামনে বড় একটা আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। এ জন্য আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আমরা এগুলো নিয়ে রাজউকের সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছি। ঢাকা শহরের ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের এখানে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, এটাও একটা বড় ইস্যু। ১৯৯৬ সাল থেকে যেহেতু আমাদের বিল্ডিং কোড আছে, সেহেতু সে সময়ের পর থেকে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ভালো অবস্থায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। তবে আমাদের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলা যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, এখনই সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারের।
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা, দুর্যোগ প্রস্তুতি, দুর্যোগকালে করণীয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা ও উদ্যোগের বিকল্প নেই। প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ নিলে ঝুঁকির পরিমাণটিই কমিয়ে আনা যায়। আমরা তো ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে পারব না। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্মকান্ড, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকি এবং মানুষের সচেতনতাই পারে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে।
ঢাকায় গত কয়েক বছরের মধ্যে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তিস্থলই ছিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্যে। তবে শুক্রবারের ভূমিকম্পের মতো ঢাকার আশপাশে উৎপত্তিস্থল রয়েছে, এমন ভূমিকম্পও মাঝেমধ্যেই হতে দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ২০০৮ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা অঞ্চলে গ্রীষ্মের সময় অনেকগুলো ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে দেখেছি আমরা।
ভূমিকম্প শনাক্তকারী সংস্থা আর্থকোয়েকট্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ১৮ মার্চ এই অবস্থানেই- দোহার থেকে ১৪.২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল।
ঢাকার কাছে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলেও গত বিশ বছরের মধ্যে একাধিক ছোট ছোট ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। তিন বছর আগে, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ছাড়া ২০০৮-এ টাঙ্গাইলের কাছে নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে বলে বলছে আর্থকোয়েকট্র্যাক। গত ১৫ বছরে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জে অন্তত চারবার ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। তবে গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে নথিবদ্ধ করা হচ্ছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পকে।