ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগমের জন্মদিন আজ। ১৯৭৪ সালের ৫ মে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মমতাজ তার চার দশকের সংগীত ক্যারিয়ারে উপহার দিয়েছেন সাত শতাধিক গান; পেয়েছেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা। ক্যাসেট থেকে সিডি এলো, সিডির দিনও ফুরিয়ে গেল। ফুরিয়ে যাননি মমতাজ বেগম! একের পর এক শ্রোতাদের উপহার দিচ্ছেন নতুন নতুন গান। নতুন গানগুলোও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
২০১৪ সালে মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’, ২০১৭ সালে হাসিবুর রেজা কল্লোলের ‘সত্ত্বা’ এবং ২০১৯ সালে মাসুদ পথিকেরই ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য পুরস্কার পান তিনি।
জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল কথা হয় এই শিল্পীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) আমার জন্মদিন! এত ঝামেলায় ভুলেই গেছি। এলাকার নানা কাজ-কর্ম নিয়ে সময় কাটছে। গত তিন দিন থেকে এলাকার মানুষের সঙ্গে আছি। নির্বাচনী বছর, এখন জনমানুষের সঙ্গে থাকতে হয়।’
বিশেষ দিনটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে সবাই যখন মনে করিয়ে দেয় তখনই মনে হয় আরও একটা বছর চলে গেছে। আবার নতুন আরেকটা বছর শুরু হলো। কত বছর হলো সেটা গোনার চেষ্টা করি। এখন তো আর কেক কাটা, কেক খাওয়া, নতুন কাপড় নেওয়া, ঘোরাফেরা- এসব করা হয় না।’ শিল্পীজীবন থেকে রাজনৈতিক জীবন। সেই জীবনের কথা মনে পড়লে কেমন অনুভূতি হয়?
ফোক সম্রজ্ঞী বলেন, ‘যে দিন চলে যায় সে দিন তো আর ফিরে আসে না। আমি কিন্তু শিল্পী এবং রাজনীতি- দুই দিকেই আছি। প্রোগ্রামও করছি। আগে শুধুই শিল্পীজীবন ছিল, ওটার একটা অন্যরকম মজা ছিল। এখন যেটা করছি সেটাও আমি আনন্দ নিয়ে, ভালোবাস নিয়ে, মায়া নিয়েই করছি। রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে আছি, একটা মায়া জন্মে গেছে। চাইলেও তো আর আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমি যেখানে যেভাবে কাজ করি সেখানে ভালোবাসা দিয়েই করি।’
আগামী দিনের প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে এ শিল্পী বলেন, ‘যতদিন বাঁচব, আল্লাহ যেন সুস্থ রেখে বাকি জীবন মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ দেন। জন্মদিনে এর চেয়ে বড় কিছু আশা করি না। আল্লাহ তুমি সুস্থ রেখো, সঠিক পথে চলার সুযোগ দিও। আমি যেন সঠিক পথে থেকে মানুষের জন্য কিছু করে যেতে পারি। ছোট্ট একটা জীবন। দেখতে দেখতে বহু বছর চলে গেল, আর কয় দিনই বাঁচব। এই কদিন মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই। আমি না থাকলেও মানুষ যেন বলে- একজন শিল্পী ছিল, মানুষের জন্য কিছু করে যেতে পেরেছে।’
সাত শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন গণমানুষের এই শিল্পী। নিজের পছন্দের কয়েকটি গানের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন’- গানটা আমার অনেক ভালো লাগে। ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু’ গানটিও অনেক পছন্দের। আমার ভালো লাগে মায়ের গান গাইতে। ‘মায়ের কান্দন’ গানটি আমার জীবনের অন্যতম এক গান। এ ছাড়া ইত্যাদিতে যে গানটি গেয়ে সারাদেশের মানুষের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলাম- মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথায় ‘রিটার্ন টিকিট হাতে লইয়া আইসাছি এই দুনিয়ায়’। এই গান গেয়ে আমি মমতাজ বেগম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আমার ভালো লাগে আধ্যাত্মিক, বিচ্ছেদ এবং বিরহের গান গাইতে।”
মমতাজ বেগম। প্রথম জীবনে বাবা মধু বয়াতী, পরে মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান এবং শেষে আব্দুর রশীদ সরকারের কাছে গান শেখেন। এর পর ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের কণ্ঠে যেমন ‘ফাইট্টা যায়’ গেয়েছেন, তেমনি গেয়েছেন ‘আগে যদি জানতাম বন্ধু তুমি হইবা পর’। গ্রাম-বাংলার গানে অত্যন্ত জনপ্রিয়তার কারণে পেয়েছেন ফোক সম্রাজ্ঞীর খেতাব। ‘বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়’- মমতাজের গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। গ্রাম-বাংলায় এই গান তখন তোলপাড় ফেলে দেয়। সেই গানের অ্যালবাম ‘প্রাণসই’ ছিল সেই বছরের সবচেয়ে বিক্রীত অ্যালবাম। এর পর ‘নান্টু ঘটক’, ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেলো গো মরার কোকিলে’, ‘পাংখা পাংখা’সহ প্রচুর জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন।
মমতাজের বাবা ছিলেন বাউল মধু বয়াতী। শৈশবেই বাবার সঙ্গে বাউল গান গাইতেন। এর পর পালাগান, জারি গানসহ বহু গান গেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথম জনপ্রিয়তা পান। পালা গানের সূত্রেই পরিচয় হয় শাহ আলম সরকারের সঙ্গে, যিনি মমতাজের বেশিরভাগ গানেরই রচয়িতা।
‘বান্ধিলাম পিরিতের ঘর, ভালোবাসার খুঁটির পর আদরের দিলাম ঘরে চাল, ও মনরে সুখেতে রব চিরকাল’- শাহ আলম সরকারের কথায় ইমন সাহার সুরে ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ সিনেমার এই গান শুনে বিমোহিত হননি এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে না। মমতাজের কণ্ঠে আরেক জনপ্রিয় গান ‘খায়রুণ লো তোর লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাতের হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ’- এই গান সারা দেশে ঝড় তোলে।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বৈচিত্র্যময় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মমতাজ বেগম। বর্তমান সময়ে এসে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। বেশ কয়েকটি গান গেয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। গানের এই সফল শিল্পী রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে নিজ এলাকা থেকে হয়েছেন সংসদ সদস্য।