মাহমুদা খানম মিতুর বাবা ও পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন দাবি করেছেন, খুন হওয়ার চার দিন আগেও মিতুকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১ জুন সকালে পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু ছেলে মাহিরকে স্কুলের বাসে তুলে দেওয়ার সময় আসামিরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মিতু তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে গেলে তারা ব্যর্থ হন।
আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্য দেন মোশাররফ হোসেন। এ সময় তিনি এসব কথা বলেন।
বাবুল আক্তারের শ্বশুর বলেন, ‘বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে চাকরি করার সময় আসামি মুসাকে তার অফিসে ডেকে মিতুকে হত্যার সব পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের গলিতে মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বাবুল। মুসা সিকদার বাবুল আক্তারের কাছে অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দাবি করেন। তখন মুসাকে নগদ ৭০ হাজার টাকা দেন বাবুল আক্তার। বাকি তিন লাখ টাকা তার বন্ধু প্রেস মালিক সাইফুল ইসলাম তাকে দেবেন বলে জানান।’
বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মিতুর বাবা গত আট বছরে এই মামলা নিয়ে ১০ রকমের কথা বলেছেন। ওনার কথার সাথে কোনো কথার মিল নেই। নানা সময়ে বিভিন্ন তদন্তকারীর নিকট বিভিন্ন ধরনের স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। ২০২১ এর আগে উনি যেসব কথা বলেছেন, পরে আবার পিবিআই অফিসে তাকে এনে যে অভিযোগটি নেওয়া হয়েছে সেটা পিবিআই প্রস্তুত করে দিয়েছে।’
আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘উনি বাবুল আক্তারকে যেভাবে দায়ী করে কথা বলছেন, ঠিক একইভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাবুল আক্তারকে নির্দোষ, সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আজ তিনি ভিন্ন কথা বলছেন। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মামলার আইওকে তার মেয়ের খুনে ভিন্ন কারণ আছে বলে চার পাতার অভিযোগ দেন। তখন এই গায়ত্রী অমর সিংয়ের যে গল্প তার অস্থিত্বই ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবুল আক্তার একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। সে হিসেবে তিনি অনেক জায়গায় হস্তক্ষেপ করেছেন। এ কারণে অনেক বড় লোকের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। সেসব বড় লোক, সন্ত্রাসী ও চাকরি জীবনে যাদের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল। তারা সবাই মিলে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। ওরাই বাবুল আক্তারের শ্বশুরকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এসব করতে বাধ্য করছেন।
সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুর রশীদ বলেন, ভিকটিম মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেছেন। আদালত পরবর্তী জেরার দিন ৮ মে ধার্য করেছেন।
এর আগে আজ বেলা পৌনে ১টার দিকে মোশাররফ হোসেনকে সাক্ষী হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করেন। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত চলা জবানবন্দিতে বাবুলের পরকীয়ার কারণে তাদের দাম্পত্যজীবনে কলহ, আসামি মুসার সঙ্গে তার স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করা—এসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেন সাক্ষী মোশাররফ।
পরকীয়ার কারণ জেনে ফেলায় মিতুকে বাবুল হত্যা করেছেন জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের বাসায় থাকা অবস্থায় মিতুর ওপর অত্যাচার আরও বৃদ্ধি পায়। ওই সময় তার মা-বাবাও তাদের সঙ্গে বাসায় থাকতেন। মিতু তার মা-বাবাকে বিষয়টি জানালে তারা বাবুলের পক্ষে সমর্থন দিত। চট্টগ্রামের বাসায় থাকার সময়েও বাবুল আক্তারের সঙ্গে গায়ত্রী অমর সিংয়ের যোগাযোগ ছিল।
মোশাররফ হোসেন তার সাক্ষ্যে গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে বাবুল আক্তারের দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক ও মেলামেশার কথা তুলে ধরেন।
মিতুকে হত্যা করে জঙ্গিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাবুলের ছিল বলে জানান তার শ্বশুর। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের এপ্রিলে বাবুল আক্তার চীনে ট্রেনিংয়ে যান। ওই সময় সে আসামি মুসাকে আবার বলে যায়, আমি চীনে থাকা অবস্থায় মিতুকে হত্যার মিশন শেষ করে দেবে। তবে বাবুল আক্তার চীন থেকে এসে জানতে পারে, মুসাকে দেওয়া কাজটি সে শেষ করতে পারেনি। চীনে থাকা অবস্থায় মিতুকে জঙ্গিরা বাসা ট্রেস করেছে জানিয়ে সে বাসা পরিবর্তন করতে বলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিতু তখন তাকে বলে, সে আসলে তারপর বাসা দেখবে। মূলত বাসা পরিবর্তনের সময় মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল বাবুল আক্তারের। ২০১৭ সালের মে মাসে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পায় বাবুল আক্তার। ওই সময় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জঙ্গি হামলা হতে পারে—এমন সংবাদ পেয়ে সারা দেশে সবাইকে এলার্ট করে দেওয়া হয়। তখন বাবুল আক্তার ভাবে যে, মিতুকে হত্যা করলে জঙ্গি বলে চালিয়ে দিতে পারব। ২০১৬ সালের ১৭ মে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্দেশে রওনা হয় সে। যাওয়ার পূর্বে মুসাকে নির্দেশ দেন মিতুকে হত্যার।’
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি মক্কা-মদিনায় হজে গিয়েছিলাম। কোনো একদিন বাদ আসর আমি কাবাঘরের পাশে ছিলাম। ওই সময় বাবুল আক্তার মিশনে ছিল। তখন মিতু আমাকে কল দিয়ে জানায়, মেয়েটি মিতুকে কল দিয়ে হুমকি দিয়েছে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার ২০১৬ সালের ৪ জুন ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেন। যোগদানের পরদিন বাবুলের ষড়যন্ত্রে মুসা অন্য আসামিদের নিয়ে চট্টগ্রামে জিইসি মোড়ে সকালে সন্তানকে স্কুলের বাসে তুলে দেওয়ার সময় মিতুকে হত্যা করে।’
মিতুর পরিবারকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে বাবুল থানায় মামলা করেন জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবুলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বন্ধু প্রেস মালিক সাইফুল তার স্টাফকে দিয়ে বাবুলের সাথে যোগাযোগ করে তিন লাখ টাকা মুসার সহযোগী মামুনের হাতে পৌঁছায়। মিতু ওই প্রেসের আংশিক মালিক। ওই টাকা মিতুর ব্যবসার লভ্যাংশ। মিতু হত্যার পরে সাইফুল ও ইরাদ আমাদের ঢাকার মেরাদিয়ার বাসায় গিয়ে বাবুল আক্তারের সাথে দেখা করে। সম্ভবত ঘটনার পরের দিন। পরবর্তীতে বাবুল আক্তার ৬ জুন পাঁচলাইশ থানায় আমাদের না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে মামলা করে। আসামিদের নাম জানা সত্ত্বেও তাদের নাম উল্লেখ না করে একটি মিথ্যা এজাহার দায়ের করে।’