তিতাস গ্যাসের পুরনো জীর্ণ লাইন, নিম্নমানের পাইপের ব্যবহার, অবৈধ সংযোগ এবং বিতরণ লাইন যথাসময়ে ও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক প্রতিনিয়ত বিপদের বার্তা দিচ্ছে। ঘটছে দুর্ঘটনা। তৈরি হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ। নিভে যাচ্ছে প্রাণ। গ্রাহকদের অসচেতনতায়ও প্রাণ ঝরছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিতাস গ্যাসের অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা সংযোগ লাইনগুলো। রাজধানীতে অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা অন্তত
৩৫ হাজার সংযোগ লাইন বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কারণ এসব লাইন অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও বছরের পর বছর ধরে, কিছু ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় পড়ে আছে, যাতে গ্যাস লিক হয়ে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি করে।
তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগ কিংবা গ্যাস বিল বকেয়া থাকলে তিতাস কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সংযোগ অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে থাকে। কিন্তু মূল বিতরণ লাইন থেকে গ্যাস সংযোগটি স্থায়ীভাবে (কিল) বন্ধ না করায় যেকোনো সময় এসব সংযোগ থেকে গ্যাস লিক হয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, তিতাস কর্তৃপক্ষের
যথাযথ তদারকির অভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ না করা এসব বিতরণ লাইনের একেকটি হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। এতে তাসের ঘরের মতো মুহূর্তেই মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ কিংবা সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে তিতাসের আওতাধীন এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনজনিত ১৪টি বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণহানি ঘটে ৫৮ জনের। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩৪ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। সেখানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ লাইন অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ না করার কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। লাইনটি থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে মসজিদের মেঝের নিচে ফাঁকা জায়গায় জমা হয়। পরে এই জমা গ্যাসে বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে।
২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ওই ভবনটি ধসে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের বেশ কিছু ভবন। ঘটনায় ১২ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় অর্ধশত। এ ঘটনা ঘটেছিল তিতাসের গ্যাস লিকেজ থেকে। দুর্ঘটনাকবলিত ‘রাখি নীড়’ ভবন থেকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ২০১৪ সালে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। তারা এ কাজ করতে গিয়ে শুধু রাইজার বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। ফলে তিতাসের গ্যাসলাইন লিক হয়ে গ্যাস নির্গমনের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীকালে গ্যাস জমে আগুনের সংস্পর্শে এসে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ, তিতাসসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এখনো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিতাসের অন্তত ৩৫ হাজার অবৈধ হাজার সংযোগ স্থায়ীভাবে (কিল) বন্ধ করা হয়নি। ফলে মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ ভবনে বিস্ফোরণের মতো ঘটনা আরও ঘটতে পারে। ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। সংস্থাটির তদন্তেও বেরিয়ে আসছে তিতাসের বিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ মূল সরবরাহ লাইন থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করার তথ্য।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মামলা তদন্তকালে তারা তিতাসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা পুলিশকে বলেছেন, রাজধানীতে স্থায়ীভাবে (কিল) বিচ্ছিন্ন না করার মতো অসংখ্য সংযোগ রয়েছে। এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কিংবা তারও বেশি হতে পারে বলে তিতাস কর্মকর্তারাই পুলিশকে জানিয়েছেন। তিতাসের আরও অন্তত ১৮ জন কর্মকর্তার সঙ্গে মামলার বিষয়ে কথা বলতে চিঠি দিয়ে ডাকবেন সিটিটিসির তদন্ত কর্মকর্তা।
তিতাস কর্মকর্তারা পুলিশকে বলেছেন, তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগ কিংবা গ্যাস বিল বকেয়া থাকলে তিতাস কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে থাকে। তারা রাইজার খুলে নিয়ে যায়। কিন্তু মূল বিতরণ লাইন থেকে রাইজার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ লাইনটি থেকে যায়। এক বছর পর সেই মূল সরবরাহ লাইন থেকে স্থায়ীভাবে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করার নিয়ম। তিতাসে জনবল স্বল্পতা এবং যথাযথ মনিটরিংয়ে ঘাটতি থাকার কারণে ২০১৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে (কিল) বন্ধ করার কার্যক্রম অনেকটাই থেমে গেছে। ফলে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করা সংযোগের সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছেই।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, বকেয়া বিল বা অতিরিক্ত চুলা ব্যবহারের কারণে কোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে সেটা তিতাস রাইজার থেকে বন্ধ করে দেয়। আইনগত কারণে এক বছর পর্যন্ত সেই সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। গ্রাহক আবেদন করলে জরিমানা পরিশোধ সাপেক্ষে আবার সংযোগ দেওয়া হয়।
হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, বৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও গ্যাসের রাইজার থাকে বাড়ির বাইরে। সেখান থেকে দুর্ঘটনা বা আগুন লাগার সম্ভাবনা খুবই কম। দুর্ঘটনা ঘটে মূলত অবৈধ সংযোগ যদি গ্রাহক রান্নাঘর পর্যন্ত নেয়। সেখানে যদি গ্যাস লিকেজ হয়ে জমে থাকে। জানালা বা অন্য কিছু দিয়ে যদি গ্যাস বের হতে না পারে, তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ৩৫ হাজার অস্থায়ী বিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ঠিক এমন তথ্যের কথা বলতে পারব না। তবে কোনো গ্রাহকের সংযোগ অস্থায়ীভাবে বিছিন্ন করলে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ স্থায়ী বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, মানুষের অবৈধ সংযোগ নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করতে হবে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবজারের ‘রাখি নীড়’ ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ঘটনার পরও স্থায়ীভাবে বন্ধ না করা সংযোগ থেকে গ্যাস লিক হচ্ছিল। সেখানে সিটি করপোরেশনের শ্রমিকরা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করতে গিয়ে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধ পান। পরে পুলিশের সিটিসিটির একটি টিম গিয়ে গ্যাস লিকেজের প্রমাণ পায়। পরে ওই বছরের ৪ জুলাই তিতাসের বিপণন বিভাগের তৎকালীন ডিজিএম সত্যজিত ঘোষের নেতৃত্বে একটি টিম এসে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনটি খুলে সংযোগটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে। সংযোগটি পুলিশের মামলার আলামত হওয়ায় স্থায়ীভাবে বন্ধ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার অনুমতি নেওয়ার কথা। কিন্তু অনুমতি ছাড়াই পাইপলাইনটি খুলে নেওয়া হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে তিতাসের তৎকালীন ডিজিএম এবং বর্তমানে ডিএমডি সত্যজিত ঘোষকে ফোন করা হলে তিনি এ সব বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এই কর্মকর্তা তিতাসের জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করতে বলেন।
তিতাসের পরিত্যক্ত লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। ওই ভবনেও তিতাস গ্যাসের একটি বাণিজ্যিক লাইন ছিল। ২০০১ সালে গ্যাস সংযোগের লাইনটি রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে সংযোগ লাইনটি মূল সরবরাহ লাইন থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়নি। যে কারণে সেটিতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল। ওই লাইনের ছিদ্র থেকে বেজমেন্টের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো একটি কক্ষের বদ্ধ কুঠুরিতে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো ঘটনা এড়াতে ২৮ দফা সুপারিশ করা হয়।
পুলিশের ওই সুপারিশমালায় অবিলম্বে সব ধরনের হাইড্রোকার্বন গ্যাস নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্তকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়। এছাড়া তিতাসের ক্ষয়প্রাপ্ত, বিনষ্ট ও পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তন, মেরামত এবং অপসারণ করতে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করার কথা উল্লেখ করা হয়। এলপিজি অথবা প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাস লিকেজ শনাক্তকরণ যন্ত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়, যাতে গ্যাস নির্গত হলে গ্যাসের উপস্থিতি সহজে বোঝা যায় এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেসব স্থানে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ অথবা এলপিজি মজুত রয়েছে সেসব স্থানে হাইড্রোকার্বন গ্যাস ডিটেক্টিং সেন্সর বা অ্যালার্ম ব্যবহার করতে হবে। প্রাকৃতিক গাস ও বিদ্যুতের সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণসহ অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত বা বিনষ্টকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তন অথবা নিয়মিত মেরামত করতে হবে বলেও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া কোনো অবৈধ গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন করা হলে পাইপলাইন সম্পূর্ণভাবে অপসারণের কথাও সুপারিশে তুলে ধরা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়ে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিতাসের গ্যাস বিতরণ লাইন মাটির নিচে বসানোর সময় মরিচা নিরোধক কালো প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। তা না করে পাইপ স্থাপন করলে মরিচা ধরে লিকেজ হতে পারে। অনেক সময় এই লিকেজ পাইপের মানের ওপরও নির্ভর করে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও তিতাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।