আগামী জুনের আগেই আরেক দফা বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম। এর আগে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকপর্যায়ে তিন ধাপে পাঁচ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির শর্তানুযায়ী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও ভর্তুকির পরিমাণ শর্তের তুলনায় বেশি, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে সমন্বয় করতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এ কথা জানানো হয়। আইএমএফের শর্ত অনুসারে ডিসেম্বরের মধ্যে জ¦ালানির প্রাইসিং ফর্মুলা করবে সরকার। এ ফর্মুলায় ভর্তুকি হবে শূন্য। এ নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে জ¦ালানি বিভাগ।
গতকালের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন। অন্যদিকে মিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যান্টেলা, সেভাকো, রিচার্ড জোনাথন, নিকি জিনেট। কার্যত মিশনের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ^ব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। সেখান থেকে ফিরে পরবর্তী বৈঠকে যোগ দেবেন।
আইএমএফ গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিনদিন পরই প্রথম কিস্তিতে ছাড় করা হয় ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে ৭টি কিস্তিতে বাংলাদেশকে ঋণের পুরো অর্থ দেবে আইএমএফ। আইএমএফ সাধারণত ঋণের প্রতিটি কিস্তি দেওয়ার আগে শর্ত পরিপালনের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করে থাকে। সে অনুযায়ী দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে ঋণের শর্তপূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি দল এখন বাংলাদেশে সফর করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করবে সফরকারী প্রতিনিধি দল। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ বৈঠক হবে এনবিআরের সঙ্গে।
অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে জানান, আইএমএফের শর্ত পরিপালনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করে ভর্তুকি কমানোর জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামগ্রিক ভর্তুকি আইএমএফ নির্ধারিত সীমায় আটকে রাখতেই সরকার ইতোমধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেলের মূল্য আগামী সেপ্টেম্বর থেকেই তিন মাস পরপর আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে নিট ভর্তুকির পরিমাণও কমিয়ে আনবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে রিজার্ভ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তপূরণে কি ধরনের সমস্যা তা জানাতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএমএফ টাগের্ট অর্জনের চেয়ে বাংলাদেশ কি ধরনের নীতি গ্রহণ করছে, সেটি দেখবে। কাক্সিক্ষত নীতি গ্রহণ না করলে ঋণ ছাড় করা থেকে সরে আসবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টার্গেট ২৪ বিলিয়ন ডলার অর্জন করতে না পারলে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটি আগেই বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে রিজার্ভের শর্তপূরণ করতে না পারলেও আগামী সেপ্টেম্বরে ২৫.৩১৬ বিলিয়ন ডলারের ফ্লোর অবশ্যই পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। প্রথম রিভিউয়ে আইএমএফ দেখবে বাংলাদেশ শর্তপূরণের জন্য আগামী বাজেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা। কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা থাকলে তা দূর করতে পরামর্শ দেবে আইএমএফ।
তবে আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় রিভিউ রিপোর্টের ভিত্তিতে আগামী নভেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করবে সংস্থাটি। ফলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শর্ত অনুযায়ী অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে। আইএমএফ গত মার্চে ২২.৯৪৭ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখার ফ্লোর নির্ধারণ করেছিল, যা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। আগামী জুনে এই ফ্লোর বাড়িয়ে ২৪.৪৬২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে সংস্থাটির। আগামী সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫.৩১৬ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬.৪১১ বিলিয়ন ডলারের ফ্লোর করে দিয়েছে আইএমএফ।
আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে আরেকটি কঠিন কাজ হলো, আগামী অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো। এনবিআর হিসাব করে দেখেছে, এটি অর্জন করতে হলে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর ও শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব আয়ের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পরও অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। কীভাবে বাড়তি এই রাজস্ব আদায় হবে, সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে, যা আজকের বৈঠকে আইএমএফের সামনে তুলে ধরবে এনবিআর।
জানা গেছে, আইএমএফের ঋণ চুক্তিতে প্রায় ৩৮টি শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সেগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি যাচাই করবে সংস্থাটি। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে যেসব শর্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আসছে বাজেটে কী কী উদ্যোগ থাকছে, তা-ও পর্যালোচনা করবে সংস্থাটি।
রিভিউ মিশনটি সুদের হার করিডর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সময়; বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন ও শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য আইএমএফের ২০২২ সালের সুরক্ষা মূল্যায়নের সুপারিশের অবস্থা; বিনিময় হারের গতিবিধি; কার্ব মার্কেট; বিনিময় হার-নীতি; বৈদেশিক ঋণ ছাড়ের তথ্য; সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক পারফর্ম্যান্স; এফডিআই প্রক্ষেপণ; জাতীয় সঞ্চয়পত্র সংস্কার ইত্যাদি খতিয়ে দেখবে।
বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কর্মক্ষমতার অবস্থা এবং নন-পারফর্মিং লোন ও রিক্যাপিটালাইজেশন, তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতির পাশাপাশি ঋণ কার্যক্রম মোকাবিলার পরিকল্পনার অবস্থা জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।