বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। তবে গত এক যুগে যে হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও উন্নয়ন হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সক্ষমতা দেখাতে পারেনি পিজিসিবি। ফলে সরকার ২০১৮ সালে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের উন্নয়নে বেসরকারি খাতে অংশীদারত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ জন্য একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করে সরকার।
কিন্তু গত ছয় বছরেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অবস্থায় আবারও নতুন করে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরার্মশক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সভায় পরার্মশক নিয়োগের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়।
জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, অনেক আগে উদ্যোগটি নেওয়া হলেও নানা কারণে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সম্পন্ন করা যায়নি। তবে চলতি মাসেই আমরা একটি বৈঠক করেছি। বৈঠকে আপাতত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে একটি পরার্মশক সংস্থা নিয়োগের।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পাওয়ার সেল ‘প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার ট্রান্সমিশন পলিসি’ নামে একটি খসড়া পলিসি তৈরি করেছে। সেই পলিসির ওপর নির্ভর করে এখন পরার্মশক সংস্থা কাজ করবে। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতকে কীভাবে সংযুক্ত করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকটা বেসরকারি আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মতো হবে। তবে সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
সরকার বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে। সেই আলোকে ২০৪১ সালের মধ্যে অন্তত ৬০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এ বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনও উন্নয়ন করতে হবে। তবে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিজিসিবি সেটা অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো করতে পারছে না। পিজিসিবি ইতোমধ্যে অনেক প্রকল্পে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণে। ফলে সরকার পিজিসিবির পাশাপাশি বেসরকারি খাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা এগিয়ে নিতে চায়।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে ‘ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার’ নীতিমালা তৈরি করে। এর ফলে পরে এসে বেসরকারি খাতে ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এখন দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি খাত থেকে নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রিড লাইন নির্মাণেও বেসরকারি খাতে সহযোগিত নিতে চাইছে সরকার।
প্রসঙ্গত সঞ্চালন লাইন ও বিতরণ লাইনের পরিধি বাড়লেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় উন্নতি কম হয়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সংকটের কারণে এখনও উৎপাদিত বিদ্যুৎ সব জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। প্রায়ই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে। এমনকি সময়মতো সঞ্চালন বিতরণ লাইন নির্মাণ না হওয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দীর্ঘসময়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করে রাজধানীর দিকে আনা যায়নি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন বিতরণ লাইনও সময়মতো হয়নি। এমনকি দেশের আর্থিক অংকে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে গেছে। এখনো নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা বাড়াতে চায় সরকার।
এদিকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাব। পরিকল্পনা ছাড়া এতদিন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেই গেছে। কিন্তু সঞ্চালন ও বিতরণ নজর দেয়নি। এখন এসে দেখছে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও সঞ্চালন ও বিতরণে পিছিয়ে আছে। ফলে যে কোনোভাবেই হোক সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা বাড়াতে বেসরকারি অংশগ্রণ বাড়াতে চায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পিজিসিবির পক্ষেই সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব। এতদিন পিজিবির দায়িত্বে কারা ছিল কেন পিজিসিবিকে শক্তিশালী করা হয়নি, সেই সব বিষয়ে খোঁজ করলেই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, এখন আবার সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোতে বেসরকারি মালিকানায় ছাড়তে চায়। বিষয়টা যাতে এমন না হয়, কোনো পক্ষকে ব্যবসা দেওয়ার জন্যই এ উদ্যোগ। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ পুরোপুরি সরকারি মালিকানায় থাকাই হবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।