বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে। সরকারের বিশাল বাজেটের বড় অংশই খরচ হয় মূলত তিনটি খাতে। সেগুলো হলো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতা, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন এবং সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখার কারণে সরকারের অনেক অগ্রাধিকার খাত ভালো বরাদ্দ পাচ্ছে না। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও তাল মিলিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ছে না। এ কারণে বাজেট বাস্তবায়নে বেড়ে যাচ্ছে ঋণনির্ভরতা। সঙ্গত কারণেই বাড়ছে ঋণের সুদ-ব্যয়।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো সুদ-ব্যয় লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করে যাচ্ছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ-ব্যয় ধরা রয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে বাজেটে সুদ-ব্যয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাচ্ছে। শতকরা হিসাবে যা ২৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায় সরকারকে ঋণ করে ব্যয় মেটাতে হয়। ফলে ঋণের সুদের হার দিন দিন বাড়ছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, গত পাঁচ বছরে এটি দ্রুত বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ বাড়ছে। অতীতের ঋণের কারণে খরচ বাড়ছে। ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দরকার।
অতীতের বাজেটগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছরই বাজেটে সুদ-ব্যয় বেড়ে চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটে ছিল ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। সুদ-ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ-ব্যয় ধরা আছে ৫ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ-ব্যয় হয়েছে ৫২ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ-ব্যয় ৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ-ব্যয় ছিল ৪৫ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি সুদ-ব্যয় ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সুদ-ব্যয় ৩৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ-ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ব্যয় যথাক্রমে ৩৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা এবং এক হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৪৪ কোটি টাকা এবং এক হাজার ৬২৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সুদ-ব্যয় ছিল ২৯ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ-ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা।
ভর্তুকি ও সুদের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা, বিভিন্ন পণ্য ও সেবায়ও বরাদ্দ বাড়ছে। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকায়, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৯.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এটি ছিল জিডিপির ৯.৭ শতাংশ।
ভর্তুকি, সুদ পরিশোধ এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার ফলে এ বছরের মূল বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ছে মাত্র ৮ শতাংশ।
সর্বশেষ সম্পদ কমিটির বৈঠকে মন্ত্রী ও সচিবরা আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। এ ছাড়া ভর্তুকি, ঋণের সুদ পরিশোধকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তারা। এত বিপুল ভর্তুকির পরও আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব বেশি সুখবর থাকছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৫.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৩৩ শতাংশ এবং এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৩৯ শতাংশ।