দেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও তেমন একটা সাড়া মিলছে না। নীতিমালা জারির পর গত চার বছরে দেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৫ কেজি। এর মানে প্রতিবছর দেশে সোনার যে চাহিদা রয়েছে, তার ১ শতাংশও বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হচ্ছে না। তবে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতিদিন প্রায় শত কেজির বেশি সোনা দেশে আসছে। অভিযোগ উঠেছে, বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সোনা আনার খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের অনেকেই কৌশলে এ পথে সোনা আনছেন।
আইনগতভাবে এই ব্যবস্থা অবৈধ না হওয়ায় এসব সোনা আটকানোও যাচ্ছে না। এ ছাড়া বৈধ আমদানি যতটা হচ্ছে, তার কয়েকগুণ বেশি সোনা চোরাচালানের মাধ্যম আসছে। এতে সরকার একদিকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাও পাচার হয়ে যাচ্ছে।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় সোনা আনার খরচ অনেক কম। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সোনা আমদানির এই খরচের ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নেওয়া না হবে, ততক্ষণ বাণিজ্যিক আমদানিও উৎসাহিত হবে না। এ ছাড়া দেশে সোনার প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ ও ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করেছে এ খাতের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)।
বর্তমানে দেশে বৈধপথে দুভাবে সোনা আমদানি করা যায়। স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে সোনা আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলসের আওতায় সোনা ও সোনার বার শুল্ক পরিশোধ করে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ একেবারেই কম। সোনার ব্যবসা বৈধতার মধ্যে আনতে ২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা করে। স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদার ১ শতাংশও বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, নীতিমালার আওতায় গত চার বছরে আটটি প্রতিষ্ঠান ১৪৫ কেজি সোনা আমদানি করেছে। যার সিংহভাগ আমদানি করেছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ১১টি প্রতিষ্ঠান এখনো পর্যন্ত কোনো সোনা আমদানি করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমাদের সময়কে বলেন, নীতিমালা মেনেই ব্যবসায়ীদের সোনা আমদানি করতে হয়। তবে কেউ যদি ব্যবসায় না থাকে, সে তো আমদানি করবে না। ব্যবসায়িক ভায়াবিলিটি যখন যার যেমন, সে সেভাবে আমদানি করে। দেশে স্বর্ণের চাহিদা অনেক। এই সামান্য আমদানি দিয়ে কীভাবে চাহিদা মিটছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু বাণিজ্যিক আমদানি দিয়েই চাহিদা মিটছে এমনটি নয়। এর বাইরে ব্যাগেজ রুলসের আওতায়ও বৈধভাবে সোনা আনার সুযোগ রয়েছে। ব্যাগেজ রুলসের কারণে বাণিজ্যিক আমদানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক আমদানি এক ধরনের আর ব্যক্তি আমদানি আরেক ধরনের। স্বর্ণ এমন একটা জিনিস, যেটা সব সময় হাতবদল হয়। সুতরাং আমি ২০০ গ্রাম আনলেও প্রয়োজন না হলে সেটি বিক্রি করে দিতে পারছি। ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
বাণিজ্যিক আমদানিতে অনীহা কেন : বাণিজ্যিকভাবে আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক, ইন্স্যুরেন্স, ফ্রেইট চার্জ, এলসির কমিশনসহ সব মিলে প্রতি ভরিতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতি ভরি সোনা আনার খরচ ২ হাজার টাকা। সোনার বারের বাইরে ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারবেন বিনাশুল্কে। আর এ কারণেই বাণিজ্যিক আমদানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাজুসের সাবেক সভাপতি ও শারমিন জুয়েলার্সের মালিক এনামুল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাগেজ রুলসের চেয়ে বাণিজ্যিক আমদানিতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে আমদানিকৃত সোনা কেউ কিনতে চায় না। কিন্তু ব্যাগেজ রুলসে আনা সোনার প্রতি সবারই আগ্রহ রয়েছে। কেননা যেখানে কম পাবে, সেখান থেকেই কিনতেই সবাই উৎসাহিত হবে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক আমদানি মার খাওয়ার মূল কারণই ব্যাগেজ রুলস। যদিও ব্যাগেজ রুলও বৈধ।
ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার : ব্যাগেজ রুলসে বলা আছে, একজন যাত্রী সর্বোচ্চ দুটি সোনার বার (২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি ওজন) ঘোষণা দিয়ে আনতে পারবেন। প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা হিসাবে মোট ৪০ হাজার ১২৪ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে একজন যাত্রী সোনার বার আনতে পারবেন। এর বাইরে ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে সোনার বার আনার ঘটনা বেশ বেড়েছে।
কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ব্যাগেজ রুলসের আওতায় শাহজালাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ১০০ কেজির বেশি সোনা আসছে। সম্প্রতি এ মাধ্যমে সোনা আসা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর অপব্যবহারের বিষয়টি সামনে এসেছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় প্রস্তাবনায় বাজুসের পক্ষ থেকেও ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলংকার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সংকট, মানি লন্ডারিং ও চোরাচালানে কী প্রভাব পড়ছে সেটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাজুসের সাবেক সভাপতি এনামুল হক খান বলেন, খরচ কম হওয়ায় এ মাধ্যমটির অপব্যবহার হতে পারে। আমাদের অনুমান, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ভরি সোনা আসছে। আর এটা ঘুরেফিরে বাজারেই আসে। এ কারণে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আমরা সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করেছি।
থামছে না চোরাচালানও : সোনার ব্যবসা বৈধতার মধ্যে আনতে ২০১৮ সালে সরকার সোনা নীতিমালা করে। ওই নীতিমালার আওতায় বৈধপথে আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও দেশে সোনা চোরাচালান থামছে না। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করেন। জব্দ হওয়া সোনার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। আর বাজুসের অনুমান, সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। বছর শেষে চোরাচালানের এই পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
তবে এসব সোনার পুরোটাই প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যায় বলে বলে দাবি সংগঠনটির। এর মানে চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে এনামুল হক খান বলেন, এখনো সোনা চোরচালান বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চোরাচালান ধরা পড়ছে। তবে আগে বিবানবন্দরে ধরা পড়ত। আর এখন ধরা পড়ছে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে। এর মানে এটা তৃতীয় দেশে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশকে শুধু রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।