মাত্র আট কর্মদিবসে স্ত্রী তাহমিনা রহমান শিশিরের ব্যক্তিগত গাড়িচালক রিপন হোসেন শামীমসহ ছয়জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিদায় নিলেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আব্দুল জলিল। বদলি আদেশ আসতেই তড়িঘড়ি করে নিয়োগ সম্পন্ন এবং শেষ কর্মদিবসে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদান করা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বলে জানা গেছে। তাদেরকে চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে ২০তম গ্রেডে (অস্থায়ী) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন অফিস সহায়ক পদে রিপন হোসেন, ফাইম আহম্মেদ, আবদুর রোহান ও আলী আহাম্মেদ, নিরাপত্তাপ্রহরী পদে মো. শাহ আলম এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে অজয় কুমার।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পাওয়া রিপনের বাড়ি মহানগরীর রাজপাড়া থানার শ্রীরামপুরে। একই পদে নিয়োগ পাওয়া ফাইম আহম্মেদ জেলা প্রশাসকের বাংলোর নাজির নূর আহমেদ টিপুর ভাতিজা। ওই পদে নিয়োগ পাওয়া আলী আহাম্মেদ ডিসি কার্যালয়ের ভি.পি শাখার অফিস সহকারী মনজুরের ভাতিজা। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে নিয়োগ পাওয়া অজয় কুমার ডিসি কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী শম্ভু নাথের ছেলে। তবে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পাওয়া আবদুর রোহান ও নিরাপত্তাপ্রহরী শাহ আলমের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত ছয়জনের মধ্যে চারজনই রাজপাড়া থানা এলাকার বাসিন্দা। বাকি একজনের বাড়ি বোয়ালিয়া ও অপরজনের তানোর থানায়। অর্থাৎ নিয়োগ ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই মহানগরীর বাসিন্দা। একজন মাত্র শহরের বাইরের উপজেলার।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২২তম বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা আব্দুল জলিল ২০২০ সালের ৫ জুলাই রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। গতকাল রোববার রাজশাহীতে ছিল তার শেষ কর্মদিবস। রাজশাহীতে দুই বছরের বেশি সময় থেকে তার কার্যালয়ে মোট ১২২ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। তার বদলির আদেশের পরও শেষ ধাপে ছয়জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিনটি পদে নিয়োগের জন্য গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আবেদনের শেষ তারিখ ছিল গত ১৬ মার্চ। এরইমধ্যে গত ১২ মার্চ ডিসি আবদুল জলিলের বদলির আদেশ হয়। তার জায়গায় নাটোরের ডিসি শামীম আহম্মেদকে পদায়ন করা হয়। এই বদলির আদেশ হওয়ার পরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে নিয়োগ কমিটি। এজন্য ১৬ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর ১৭ ও ১৮ মার্চ শুক্র ও শনিবার হওয়ার কারণে ছুটি ছিল।
পরদিন ১৯ মার্চ অর্থাৎ আবেদনের তারিখ শেষ হওয়ার ঠিক পরের কার্যদিবসেই চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ডাকযোগে প্রবেশপত্র পাঠানো হয়। এতে পরীক্ষার তারিখ উল্লেখ করা হয় ২৪ মার্চ। সেদিন লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ডিসির বিদায় বেলায় তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়।
ডিসির কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা থেকে জানা গেছে, চারজন অফিস সহায়ক এবং একজন করে নিরাপত্তাপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। চারজন অফিস সহায়কের পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন ৬৫১ জন। এছাড়া একজন নিরাপত্তাপ্রহরীর জন্য ৪৫ জন ও একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদের জন্য ১৭ জন আবেদন করেন। এদের মধ্যে অফিস সহায়ক পদের ৫২১ জন, নিরাপত্তা প্রহরীর ৩৪ জন এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ১৪ জন পরীক্ষায় বসেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পান অফিস সহায়ক পদের মাত্র ২০ জন এবং অন্য দুই পদের প্রতিটিতে পাঁচজন করে। মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের পর তিন পদে ছয়জনকে এসএ শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়।
আজ সোমবার দুপুরে রাজশাহী প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখায় গিয়ে দেখা মেলে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ফাইমসহ আরও একজনের। ফাইম রাজশাহীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে জানান।
ফাইম জানান, চাকরি বাজার কঠিন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়েও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে চাকরিতে যোগদান করেছেন।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রো-গ-৩৪৫০৫৬ নম্বরের একটি প্রাইভেট কার আব্দুল জলিলের নামেই রেজিস্ট্রেশন করা। তার বাবার নাম আবুল কালাম মাতবর। ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাসার ঠিকানায় গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে। তবে এই গাড়িটি ব্যবহার করতেন তার স্ত্রী তাহমিনা রহমান শিশির। ডিসির স্ত্রীর গাড়ি চালাতেন রিপন হোসেন শামীম। তিনি নিয়োগ পেয়েছেন অফিস সহায়ক পদে।
এদিকে, বদলির আদেশ হওয়ার পরও ডিসি আবদুল জলিল নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন রোববার পর্যন্ত। এদিনই যোগদান করেন নতুন নিয়োগ পাওয়া ছয় কর্মচারী। পরদিন সোমবার ডিসি আবদুল জলিল অফিস করেননি। আজ মঙ্গলবার তার রাজশাহী ছাড়ার কথা।
নিয়োগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি রাজশাহী জেলার প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব সানিয়া বিনতে আফজল।
নিয়োগ কমিটির সমন্বয়ক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ শরিফুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘নিয়োগপ্রাপ্তরা ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয় কি না, তা আমি জানি না। আর ডিসি স্যারের স্ত্রীর গাড়িচালক নিয়োগ পেয়েছেন কি না, তাও জানা নেই। তবে নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি- এটা বলতে পারি।’
শেষ কার্যদিবসে নিয়োগের বিষয়ে বিদায়ী ডিসির সঙ্গে কথা বলতে কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার বাংলোতে গিয়ে দেখা যায়, বাসা ছাড়ার আয়োজন চলছে, ফলে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এর আগে নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনেক আগেই প্রকাশ করা হয়েছিল। আমার পরে যে ডিসি আসবেন, তাকে পেইন দিতে চাই না। তাই নিয়োগ প্রক্রিয়াটা শেষ করছি।’