১৩টি রাজ্য ও তিনটি প্রদেশে নানা ধর্মের মানুষের বাস দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায়। দেশটির মোট আয়তন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার। দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুর এবং ফেডারেল সরকারের রাজধানী পুত্রজায়া।
দেশটিকে ভাগ করেছে দক্ষিণ চীন সাগর। একপাশে মালয়েশিয়া উপদ্বীপ এবং অন্যপাশে পূর্ব মালয়েশিয়া। দেশটির সীমান্তঘেঁষা দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাই। এ ছাড়া সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সঙ্গে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম উন্নয়নশীল এ দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখের অধিক।
মালয়েশিয়ার সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ইসলাম ফেডারেশনের ধর্ম। তবে অন্য ধর্ম ফেডারেশনের যেকোনো অংশে নিরাপদে এবং শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা যেতে পারে।’ অন্যদিকে ধর্মের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম পালন ও পালন করার এবং ধারা (৪) এর অধীন, তাদের নিজস্ব ধর্ম বিকাশের অধিকার রয়েছে।’ এর মানে হলো, মালয়েশিয়া ইসলামকে সরকারি ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলেও মালয়েশিয়ার মানুষ বিভিন্ন বংশ ও বিশ্বাস নিয়ে গঠিত, তারা স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালন করতে পারেন।
প্রায় ৬১.৩ শতাংশের মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ার ধর্ম ও সংস্কৃতি নানা বৈচিত্র্যময়। ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে মালয়েশিয়ানদের ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়।
পবিত্র রমজানে এই বন্ধন আরও স্পষ্ট হয় তাদের ‘গোটোং রোয়ং’ অনুষ্ঠানে। এর অর্থ পারস্পরিক সহযোগিতায় কোনো কাজ করা। অর্থাৎ রমজান শুরু হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে জুমার নামাজের আগেই নির্ধারণ করা হয়, কোন দিন ওই এলাকার সব মুসল্লি একত্র হয়ে মসজিদ ও তার চারপাশের আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবেন।
মালেশিয়ানদের গোটোং রোয়ং অনুষ্ঠানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চিত্র
মালয়েশিয়ান ভাষায় ‘পুয়াসা’ মানে রোজা। রমজানের আগমনী বার্তা সবার কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পালন করা হয় ‘শাহরুন মোবারাকুন’। সাইরেনের শব্দ ও ‘শাহরুন মোবারাকুন’ বলে অভিবাদন জানিয়ে এবং উপহার বিনিময় করে শুরুতেই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে মজবুত করে নেয় মালয়েশিয়ানরা। সরকার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয় রমজানে।
মাসজুড়েই কানায় কানায় পূর্ণ থাকে মসজিদ। তারাবিসহ অন্য নামাজে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারাবি শেষে বিশেষ শিক্ষামূলক আসর বসে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলোতে। সেহেরির পর ঘুমানোর অভ্যাস নেই মালয়েশিয়ার মুসলমানদের। সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থানীয় মসজিদে ধর্মীয় আলোচনা শুনে সূর্য উঠলে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়েন তারা।
রমজানে বেশ অতিথিপরায়ন হয়ে ওঠেন মালয়েশিয়ানরা। মসজিদগুলোতে বিনামূল্যে ইফতারির সুযোগ থাকে সব ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফ্রি ইফতারের ব্যবস্থার কোনো কমতি নেই। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে এই ফ্রি ইফতার করেন।
মসজিদে মসজিদে ইফতারিতে বিনামূল্যে শরবত ও বুবুর অর্থাৎ নরম খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকে। চাল, মাংস, নারিকেলের দুধ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে ‘বুবুর লেম্বাক’ তৈরি করা হয়। প্রায় পাঁচ দশক ধরে কুয়ালালামপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে খাবারটি বিতরণের প্রচলন হয়ে আসছে।
মালয়েশিয়ানদের ইফতারিতে ‘বুবুর লেম্বাক’ খাবার
এ ছাড়া রমজান ঘিরে মালয়েশিয়ায় থাকে বিশেষ আয়োজন। সেটি চলে মালয়েশিয়ার শাহ আলম, পেনাং, কোয়ান্তান, মেলাকাসহ প্রতিটি রাজ্যে। এমনকি মারদেকা মাঠেও নেওয়া হয় বিশেষ ইফতারের উদ্যোগ। মালয়েশিয়ায় স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রকারের হাতে বানানো পিঠা, হালুয়া জাতীয় নাশতা, সাদা ভাত, ফলমূলসহ মালয়েশিয়ান খাবার দিয়ে ইফতার করেন। সঙ্গে থাকে আম, তরমুজ, বাঙ্গি, কলা, পেঁপে, আপেল, আঙুর, কমলাসহ নানা রকমের মালয়েশিয়ান ফল।
মালেশিয়ানদের ইফতারিতে খাবারের চিত্র
মসজিদে মসজিদে তারাবির আদায় করা হয়। এ মাসে দেশটির মসজিদগুলোতে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যায়। দেশটিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান। নামাজের পরে কুরআন তেলাওয়াত করতে পছন্দ করেন মালয়েশিয়ানরা।
বাজার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রমজান মাসে প্রায় পাঁচ হাজার স্টলসহ মোট ৭২টি রমজান বাজারের অবস্থান মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর জুড়ে। কামপুং বারু, বাংসার, টিটিডিআই, স্টেডিয়াম শাহ আলম, বুকিত বিনতাং, কেলানা জায়া, মেলাওয়াতী, মসজিদ ইন্ডিয়া, বান্দর তুন রাজাক, এসএস ১৩। এর মধ্যে অধিকাংশ বাজারই প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে শুরু হয়। এরপর গরম গরম সর্বোত্তম খাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন ব্যবসায়ীরা।
মালয়েশিয়ায় সাধারণত শুকনো খাবার বা খেজুর দিয়ে মুসলমানেরা রোজা ভাঙেন। এ ছাড়া থাকে দেশীয় কিছু বিখ্যাত ইফতার আইটেম। মালয় লোকজনের কাছে ইফতার আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বারবুকা পুয়াসা’। এটি আখের রস এবং সোয়াবিনের দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন সামগ্রী। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার ইফতারে থাকে নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস, আয়াম পেরিক, লেমাক লাঞ্জা ইত্যাদি।
অবিশ্বাস্য হলেও রমজানে মালয়েশিয়ায় নিত্যপণ্যের দাম ১ টাকা না বাড়িয়ে উল্টো পণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। রমজান আসার আগে ভোজ্যতেল ও চিনি, মাছ, তরকারির যে দাম ছিল, এখনো তেমনই রয়েছে। মালয়েশিয়ায় খোলাবাজারে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি হয় না। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চেইন সুপারশপ, হাইপার মার্কেটগুলোতে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি হয়
সরেজমিন সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটগুলোতে দেখা গেছে, রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে ডিসকাউন্ট স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সব সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটগুলোর মধ্যে রয়েছে মাইডিন, জায়ান্ট, এনএসকে, ইকোনসেভ, সেগি ফ্রেশ ও জায়াগ্রোসারি ইত্যাদি।
দেশটিতে পণ্যসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী, খাবার হোটেল, মুদি দোকান, চেইন সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান খুব কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন দেওয়ান বান্ডারায়া কুয়ালালামপুর (ডিবিকেএল) নামে সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো অনিয়ম দেখলে গ্রেপ্তারসহ জেল-জরিমানা করেন তারা। এ জন্য পণ্যের দাম বাড়ান তো দূরের কথা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য রাখাসহ কোনো অনিয়ম করার সাহস পান না ব্যবসায়ীরা।
মালয়েশিয়ানদের পাশাপাশি দেশীয় খাবারে ইফতার করেন প্রবাসী বাংলাদেশিদেরা। সুদূর প্রবাসে থেকেও তাই তৃপ্তি মেটাতে ইফতারে বাঙালি খাবারই তাদের প্রথম পছন্দ। তাই মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা রমজান পালন করেন অনেকটা দেশীয় আমেজে।
মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইফতার চিত্র।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইফতারিতে খেজুর, জিলাপি, সরবত, জুস, হালিম, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, লাচ্চিসহ নানা প্রকারের খাবার রাখা হয়। বাংলাদেশিরা যেখানে থাকেন, সেখানেই একসঙ্গে তারা ইফতার করেন। তাই মালয়েশিয়ানদের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের আয়োজনটা বড় হয়। মালয়েশিয়ানরাও অভিভূত হয় বাঙালিদের ইফতারির বিশাল আয়োজন দেখে।