করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে পণ্য ও সেবামূল্য বেশ চড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় ও সংসারের খরচ বেড়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। কিন্তু ব্যয় ও খরচ অনুপাতে আয় বেড়েছে এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। যাদের আয় বাড়েনি তাদের অনেকেই সংসার চালানো ও বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছেন। এতে ব্যাংকের ভোক্তা ঋণে বড় উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ভোক্তা ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি এবং কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১৪ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ড ও নিজ স্যালারি অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি প্রভিডেন্ট ফান্ড ও ব্যাংকে জমানো সঞ্চয় লিয়েন রেখেও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি, মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও ফার্নিচার ক্রয়েও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
সাধারণভাবে ভোক্তা ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়। ভোক্তা ঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ভোক্তা ঋণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের সংসারের খরচ ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি অনেকের, বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের। ফলে খরচের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই তা পারছেন না। যারা পারছেন না তারা ঋণ নিয়ে হলেও বাড়তি খরচ সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, রোজার মাসেও পণ্যমূল্য বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে খরচ বেড়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হবে। যার চাপ পড়বে মূল্যস্ফীতিতেও।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তা ঋণে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে করোনার কারণে স্থবির অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ভোক্তা ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে সব ধরনের অশ্রেণিকৃত ভোক্তা ঋণে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হতো, যা ওই সময় কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যসব ভোক্তা ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে ভোক্তা খাতে ঋণ বিতরণে বেশ আগ্রহ দেখায় ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে সুদের হার তুলনামূলক কম হওয়ায় সাধারণ মানুষও সংসারের বাড়তি খরচসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এই ঋণ নিতে উৎসাহিত হন। তবে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ভোক্তা ঋণের সুদহার সীমা বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ভোক্তা ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা বা ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে বেড়েছে ১৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের পুরো সময়ে ভোক্তা ঋণ বেড়েছিল মাত্র ১৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা বা সাড়ে ১৬ শতাংশ। করোনা মহামারীর বছর ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। শুধু ভোক্তা ঋণের পরিমাণই নয়, এ সময়ে ভোক্তা ঋণের গ্রাহকও বেড়েছে বেশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভোক্তা ঋণের মোট গ্রাহক ছিল ২৮ লাখ ১০ হাজার ৪৭২ জন। যা গত বছর ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ২২ জন। এ হিসাবে ২০২২ সালে ভোক্তা ঋণের গ্রাহক বেড়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৫৫০ জন।
ভোক্তা ঋণ বাড়ার পেছনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি নয়-ছয় সুদহারও দায়ী বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, গত বছরজুৃড়ে পণ্যমূল্য বাড়লেও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যান্য ভোক্তা ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এতে ভোক্তার পক্ষে ঋণ নেওয়া সহজ হয়েছে। যদিও সম্প্রতি ভোক্তা ঋণের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় না বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে দীর্ঘদিনের ভোগ্যব্যয়ের ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার জন্য অনেকেই পুঁজি ভেঙে খাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন। ভোক্তা ঋণ মূল্যস্ফীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেই ভোক্তা ঋণ বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আরএফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মহামারী করোনার প্রভাব ছিল ২০২১ সালেও। ফলে ওই বছর ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল কম। কিন্তু ২০২২ সালের করোনা থেকে রিকভ্যারি হয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। একই সঙ্গে প্রচুর মূল্যস্ফীতি হয়েছে। তাছাড়া আমাদের অর্থনীতির আকারও প্রতিবছর বাড়ছে। সবকিছু বিবেচনায় আমাদের ভোক্তা ঋণও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৮ জন চাকরিজীবী নিজ বেতন হিসাবের বিপরীতে ঋণ নিয়েছিলেন ১৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫১ জন। আর ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা কমলেও শেষ তিন মাসের হিসাবে বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৪২ জন ব্যক্তি নিজ সঞ্চয়ের বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন ৯ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪৪ জন, আর ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৩ জন গ্রাহক ঋণ নিয়েছিলেন ৪ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা।
তবে একই সময়ে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ও গ্রাহক দুইই বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। আর গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৩২। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮৯৮ জন ঋণ নিয়েছেন ২৪ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা।
এ সময়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপরীতেও ঋণ বেড়েছে। গত বছর শেষে এ খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে ব্যাংকের ঋণ ছিল ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। শিক্ষার ব্যয় নির্বাহে ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার ব্যয় মেটাতে ২ হাজার ৫২০ জন ঋণ নিয়েছেন ৭১৬ কোটি টাকা। যা ২০২১ সালে ছিল ৫৭৪ কোটি টাকা।
উচ্চ সুদের পরও ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এ সময়ে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৫ জন। বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিতে পারে ব্যাংকগুলো।
বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য তথা টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও ফার্নিচার ক্রয়েও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে গত বছর। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এসব ভোগ্যপণ্যের গ্রাহক ছিল ৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৫ জন। এসব পণ্য ক্রয় বাবদ তাদের ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ২৪ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে এসব পণ্য ক্রয়ে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৫১ জন গ্রাহক ঋণ নেন ৩৩ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ সময়ে গাড়ি ও মোটরসাইকেল কেনায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ১৮ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
২০২২ সালে ফ্ল্যাট ও প্লট কেনায় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়লেও গ্রাহক কমে গেছে। এ সময়ে ফ্ল্যাট কেনায় ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ফ্ল্যাট ক্রয় খাতে ব্যাংকের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। ৪৫ হাজার ৬৫১ জন গ্রাহক এই ঋণ নিয়েছেন। একই সময়ে প্লট তথা জমি কেনায় ১৪ হাজার ৬৩৫ জন গ্রাহক ঋণ নেন ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৮০০ জন গ্রাহক ঋণ নিয়েছিলেন ৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক কমার পরও ঋণের পরিমাণ বেড়েছে এ খাতে।