বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগির দাম নিয়ে বিতর্কের পর খামারিরা অভিযোগ করেছেন, মুরগি পালন এবং সেগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোর কাছে তারা ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছেন।
তাদের অভিযোগ, বড় কোম্পানিগুলো প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংসের জন্য নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে। যা শুধু প্রান্তিক খামারিই নয় বরং ভোক্তাদেরও প্রভাবিত করে। সরকারের কাছে বার বার ধর্না দিয়েও এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে ছোট খামারিদের।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন তালুকদার বলেন, ব্রয়লার মুরগির চাষ বাংলাদেশে এখন নীলচাষের মতো হয়ে গেছে। যেখানে প্রান্তিক খামারিদের বাধ্য করা হচ্ছে বড় কোম্পানীগুলোর সাথে চুক্তিতে মুরগি পালন করতে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও বলছে যে উৎপাদন খরচের ব্যাপক পার্থক্য থাকার কারণে বড় কোম্পানীগুলোর সাথে বাজারে টিকতে পারছে না প্রান্তিক খামারিরা। ফলে অনেক প্রান্তিক খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এরফলে ব্রয়লার মুরগির বাজারটা বড় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। তবে বড় কোম্পানিগুলো অবশ্য বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ২৫০-২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকার মতো বলে জানায় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। সম্প্রতি মুরগির এই আকাশচুম্বী দাম নিয়ে বিতর্ক চলছে।
‘নীলচাষের মতো হয়ে গেছে’
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ সব পর্যায়ে এক নয়। বড় কোম্পানিগুলো কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা হলেও প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ ১৭৫ টাকার মতো পড়ে।
তিনি বলেন, ‘এ কারণেই এই শিল্পটা প্রান্তিক খামারিদের কাছে নাই। চলে গেছে কর্পোরেট হাউজদের কাছে। যার কারণে বাংলাদেশের মানুষ জিম্মি হয়ে গেছে।’
হাওলাদার অভিযোগ করেন, কর্পোরেট কোম্পানিগুলো তখনই দাম কমিয়ে দেয় যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে যথেষ্ট উৎপাদন থাকে। যেহেতু তাদের (কোম্পানিগুলোর) উৎপাদন খরচ প্রান্তিক খামারিদের তুলনায় ৩০-৪০ টাকা কম থাকে, তাই দাম কমিয়ে রাখলেও তাদের লাভ হয়। কিন্তু এতে লোকসানের মুখে পড়ে প্রান্তিক খামারিরা।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এর আগে ব্রয়লার মুরগির দাম যখন ১৫০ টাকা ছিল তখন মূলত সেটার দাম ১৮০ টাকা হওয়া উচিত ছিল। কারণ প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচই ছিল ১৫০ টাকার মতো। খামার পর্যায়ে এই মুরগি ১১০ টাকা করে বিক্রি করতে হয়েছে প্রান্তিক খামারিদের। সেখানে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে কেজিতে ৪০ টাকার মতো। ফলে অনেক খামারিকে খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তবে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর খরচ কম থাকায় তারা লাভ করতে পেরেছে।
বাংলাদেশে মুরগির খাবার হিসেবে যে ফিড ব্যবহার করা হয় তার শতভাগই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বাচ্চাও উৎপাদন করে বড় কোম্পানিগুলো। তাই এসব বাচ্চা ও ফিড বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই কিনতে হয় প্রান্তিক খামারিদের।
হাওলাদার অভিযোগ করেন, কর্পোরেট হাউজ বা বড় কোম্পানিগুলো প্রান্তিক খামারিদের কাছে মুরগির বাচ্চা ও ফিড সরবরাহ করতে চায় না। আর করা হলেও সেটার দাম বেশি পড়ে। তার অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সাথে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যেতে বলা হয় প্রান্তিক খামারিদের।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং হচ্ছে, কোনো খামারির শুধু মুরগি লালন-পালনের ঘর থাকতে হবে। বাকি অন্য সব যেমন মুরগির বাচ্চা, ফিড, টিকা ও ওষুধ- সবই সরবরাহ করবে সংশ্লিষ্ট কর্পোরেট কোম্পানি। খামারিকে শুধু মুরগির লালন-পালনে বড় করে তুলতে হবে।
মুরগি বড় হলে সেটি বাজারজাত করবে ওই কর্পোরেট কোম্পানি। বিনিময়ে খামারিকে নির্দিষ্ট হারে একটি আয় দেয়া হয়। হাওলাদার বলেন, কেজি প্রতি ১০ টাকা লাভ দিয়ে মুরগি নিয়ে যায় কোম্পানি। সেখানে খামারির কিছু করার থাকে না। তাই হাওলাদার বলেন, এই অবস্থায় একজন খামারি শ্রমিক হিসেবে খাটছে উল্লেখ করে এই অবস্থাকে ‘নীলচাষের মতো হয়ে গেছে’।
বাংলাদেশে ব্রয়লারের ডিম ও মুরগির ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে প্রান্তিক খামারিরা। তবে তার পরো বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই বলে অভিযোগ করে খামারিদের এই সংগঠন।
হাওলাদার বলেন,‘তারা মাত্র ২০ ভাগ উৎপাদন করে কিন্তু তারাই বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করেন, এটাই বাস্তবতা। তারা দাম বাড়িয়ে দিলে বাজারে দাম বাড়ে, আর কমিয়ে দিলে দাম কমে’।
তিনি আরো বলেন, ‘তার মানে বড় কোম্পানি চাচ্ছে আমরা প্রান্তিক খামারিরা লসের সম্মুখিন হয়ে তারপর যেন তার ধর্না ধরি, তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ি। আর জিম্মি হয়ে পড়ছি অলরেডি’।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে বাচ্চার দাম ৩৫ টাকা, ফিড দু’হাজার ৬০০ টাকা ধরা হয়। তবে বাইরে থেকে কিনতে গেলে বাচ্চা ৬০ টাকা, এক বস্তা ফিড তিন হাজার ৬০০ টাকা করে কিনতে হয়। যার ফলে কর্পোরেট কোম্পানি ও প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে উৎপাদন খরচে পার্থক্য থাকে বলে জানান তিনি। এর ফলে খামারিদের সাথে সাথে ভোক্তাদের জিম্মি করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
‘প্রান্তিক খামার অর্ধেকে নেমেছে’
বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার পর এ নিয়ে গত ৯ মার্চ সব পক্ষকে সাথে নিয়ে বৈঠক করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এই সংস্থাটি বলছে, মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এর পেছনে একটি গোষ্ঠী কাজ করছে উল্লেখ করে অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, এরই মধ্যে এই বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়েছেন তারা। তারাই এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
সফিকুজ্জামান বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু খামারিরা এই মুরগি বাজারজাত করতে পারছে না।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বেশি, টেকনলজিও আছে, এ কারণে তারা এই বাজারটা অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে এবং এ কারণে প্রান্তিক যে চাষীরা আছে তারা তাদের সাথে কম্পেটেটিভনেস হারাচ্ছে।’ একই কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো প্রান্তিক খামারি ছিলেন যারা ব্রয়লার মুরগি পালন করতেন। বড় কোম্পানির কাছে বাজার হারিয়ে বর্তমানে এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। এই সমস্যাগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে পাঠানো হচ্ছে বলে জানান সফিকুজ্জামান।
‘আমরা কাউকে বাধ্য করি না’
বাংলাদেশে যেসব বড় কোম্পানি মুরগির ফিড আমদানি ও বাজারজাত করে তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী ফার্মস গ্রুপ। এই কোম্পানিটি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংও করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার ড. হাফিজুর রহমান কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের বিষয়ে বলেন, তারা কখনো কোনো খামারিকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করতে বাধ্য করেন না।
তিনি বলেন, এটা খামারির সাথে কোম্পানির একটা ব্যবসা। খামারিদের এর অফারগুলো সম্পর্কে জানানো হয়। তারা যদি রাজি থাকে তাহলেই তাদের সাথে চুক্তি করা হয়।
তিনি আরো বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে খামারিকে যে বাচ্চা ও ফিড দেয়া হয় তার জন্য কোনো দাম ধরা হয় না। বরং খামারিকে যে টাকা দেয়া হবে সেটি হিসেবের জন্য একটা দাম ধরা হয়। এটা কোন রেট না। আমরা তো বিক্রি করছি না। তাকে যে বাচ্চা আর ফিড দেয়া হয় সেটা কোম্পানির প্রোপার্টি।
আর খামারি যেহেতু সেটি পালন করে তাই মুরগি বড় হওয়ার পর তাকে একটি বেনেফিট (অর্থ) দেয়া হয়। কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের বাইরে কাজী ফার্মস মুরগির ফিড ডিলারের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে। আর এই ফিডের পুরোটাই আমদানি করা হয়।
কারণ ফিডের মূল কাঁচামাল ভুট্টা এবং সয়াবিন বাংলাদেশে পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না। কিছু ভুট্টা উৎপাদন হলেও বাকি সব কাঁচামাল আমদানি করা হয়। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে এসব কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে। যার কারণে ফিডেরও দাম বাড়তি বলে জানায় কাজী ফার্মস।
তিনি বলেন, ‘যে ভুট্টা ছিল ১৮ টাকা সেটা এখন ৪৮ টাকার মতো খরচ হচ্ছে কেজি প্রতি। যে সয়াবিন মিল (সয়াবিনের খৈল) ৩০-৩৫ টাকায় পাওয়া যেতো সেটা এখন ৮০-৮৫ টাকা প্রতি কেজি।’
রহমান বলেন, কাঁচামাল নিয়ে আসতে না পারার কারণে বাংলাদেশে অনেক ফিড মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে, বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার পেছনে তাদের কোনো হাত নেই উল্লেখ করে রহমান বলেন, বাজার তারা নিয়ন্ত্রণ করেন না। বরং চাহিদা আর যোগানের ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়।
তিনি আরো বলেন, তার কোম্পানি ব্রয়লারের বাজারের তিন-চার ভাগ উৎপাদন করে মাত্র। বাকি সব উৎপাদন করে খামারিরা। ফলে দাম বাড়ার কারণে খামারিরাও লাভবান হচ্ছে।