জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রশাসনিক কর্মকর্তা নীহার বেগম। ২৮ বছর আগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটিতে নিয়োগ পান তিনি। এত বছর পর এসে তার সেই নিয়োগ জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখন নীহার বেগমের বিরুদ্ধে নিয়োগবিধি অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। নীহার বেগমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিন মাস আগে মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হলেও এখনো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংস্থাটি।
নীহার বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ১৯৯৫ সালে জাতীয় মহিলা সংস্থার গ্রামীণ মহিলা প্রকল্পে ‘মাঠ সমন্বয়ক’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রেক্ষিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন নীহার বেগম। ওই সময় গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প নামে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ছিল। নীহার বেগম তখন ওই প্রকল্পে নিয়োগ পেতে পরীক্ষা দিলেও পরবর্তী সময়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে মহিলা সংস্থার অফিস সহকারী হিসেবে রাজস্ব খাতে নিয়োগ পান। এর পর সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তার মাধ্যমে পদোন্নতিও পেয়ে যান তিনি। দুবার পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি সংস্থাটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন
এই অভিযোগের বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নীহার বেগমের নিয়োগসংক্রান্ত তদন্ত শুরু করা হয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপক কুমার রায়ের করা তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়োগ নিয়মবহির্ভূতভাবে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় মহিলা সংস্থা ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি একটি দৈনিক পত্রিকায় তিন বছর মেয়াদি গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৬৪টি ‘মাঠকর্মী’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে নীহার বেগম আবেদন করেন। একই বছর ১৮ মার্চ সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতে মাঠকর্মী পদের পরিবর্তে নির্বাচনী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানা শাখার নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক রাজস্বভুক্ত পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে এ বিষয়ে নির্বাচনী কমিটির সিদ্ধান্তের কোনো রেজুলেশন বা লিখিত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। ফলে কোন কারণে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের জন্য সার্কুলার জারি করা হলেও সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে সাক্ষাৎকার নিয়ে গ্রামীণ মহিলা প্রকল্পের মাঠকর্মী পদের পরিবর্তে নীহার বেগমকে রাজস্বভুক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হলো তা জানা যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া এ পদে এভাবে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিনা তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যেখানে প্রকল্পভুক্ত পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে রাজস্বভুক্ত পদের জন্য অবশ্যই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিসহ যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা বিধিসম্মত হয়নি বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সংস্থার নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক নীহার বেগমের চাকরি স্থায়ী করা হয়। ওই সময় চাকরি স্থায়ীকরণপত্রে ৩০ জনের নামের তালিকা থাকলেও কেবল নীহার বেগমের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়।
নীহার বেগম তার নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, তিনি গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে মাঠকর্মী পদে আবেদন করে রাজস্ব খাতে নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগ দেন। পরে বাছাই কমিটির সুপারিশ ও নির্বাহী কমিটির অনুমোদনে উপজেলা সংগঠক পদে পদোন্নতি পান তিনি। এরপর ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পদোন্নতি পাওয়া পদে স্থায়ী হন। পরে নীহার বেগম জাতীয় মহিলা সংস্থার বাছাই কমিটির সুপারিশ এবং নির্বাহী কমিটির অনুমোদনে দ্বিতীয়বার পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির দাবি জানান তিনি।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপক কুমার রায়ের করা তদন্ত প্রতিবেদনটি গত ২১ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা হয়। এরপর এ তদন্তের বিষয়ে গত বছর ৫ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব দিলীপ কুমার দেবনাথের স্বাক্ষরে নীহার বেগমের বিরুদ্ধে নিয়োগবিধি অনুসরণ করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়।
তিন পাতার তদন্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে ওই চিঠিতে বলা হয়, নীহার বেগমের রাজস্ব পদে নিয়োগে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ হয়নি মর্মে প্রতীয়মান হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে জাতীয় মহিলা সংস্থার নিয়োগবিধি অনুসরণ করে নীহার বেগম, প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ ও তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মহিলা সংস্থার অভিযুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা নীহার বেগম আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে কোনো বিষয়ে সাংবাদিককে বক্তব্য দিতে হলে আগে আমাকে আমার কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া লাগবে। আমার কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো বক্তব্য দেব না।’ বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নয়, আপনার বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে কী বলবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এটা আমি মনে করি কর্তৃপক্ষের বিষয়।’
তবে নীহার বেগমের নিয়োগের তদন্তের বিষয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আবেদা আকতার আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়া গেছে। তারা যে সুপারিশ করেছেন, আইন ও নিয়ম অনুযায়ী যা হওয়ার তা হচ্ছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’