সাপ্তাহিক ছুটির দিন গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কদমতলীর সাদ্দাম মার্কেট বাজারে পরিবারের জন্য মাংস কিনতে এসে এক দোকান থেকে আরেক দোকান ঘুরে ঘুরে হতাশ মো. মিজান হোসেন। গরু, খাসি এবং বিভিন্ন মুরগির মাংসের আগুন দাম দেখে আক্ষেপ করে বলে ওঠেন, ‘যা দিনকাল আইলো, নসিব থেকে মাংস খাওয়াই উঠে গেছে।’
পেশায় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা কর্মী মিজান আরও বলেন, ‘২৫০ টাকা কেজি হিসেবে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ব্রয়লার কিনতে খরচ পড়ছে ৩৭৫ থেকে ৫০০ টাকা। সামান্য বেতনের টাকায় এত দামে মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। অন্য মুরগির দাম আরও বেশি। গরু-খাসির কথা বাদই দিলাম। সেগুলো খাওয়া ছেড়েছি অনেক আগেই।’
দাম অত্যধিক বাড়ায় মাংস খাওয়া কমাতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। আগে যেখানে সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন মুরগির মাংস কিংবা মাসে একবার হলেও গরুর মাংস কিনে খেতে পারতেন, সেখানে এখন গরুর মাংস একেবারেই বাদ পড়েছে। অপরদিকে মুরগির দাম, বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহে একদিন মুরগি খেতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, আগে মাসে পাঁচ-ছয় কেজি ব্রয়লার মুরগি আর এক থেকে দুই কেজি গরুর মাংস কেনা যেত। দাম বাড়ায় বাসায় মেহমান না এলে গরুর মাংস এখন আর খাওয়া হয় না। দেশি বা সোনালি মুরগিও কেনা বাদ। ব্রয়লারেরও যে দাম তাতে সুবিধা ও প্রয়োজন অনুযায়ী মাঝেমধ্যে কিনে খাচ্ছি।
মালিবাগ বাজারে আক্ষেপের কথা জানাচ্ছিলেন রিকশাচালক মো. শহীদ উদ্দিনও। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো গরিবের কপালে এখন আর মাংস, দুধ, ডিম নেই। খরচে কুলায় না, তাই এগুলা খাওয়া ছাইড়া দিছি। শুধু পোলাপাইনগুলার জন্য খারাপ লাগে।’
মাসের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে একে একে সব ধরনের মাংসের দাম বেড়েছে। মুরগির বাজারে উত্তাপ চরমে পৌঁছেছে। একইভাবে সোনালি ও দেশি মুরগির দামও ছুটছে। পবিত্র শবেবরাতকে কেন্দ্র করে গরুর মাংসের দামটাও এক লাফে ৮০০ টাকা ছুঁয়েছে, যা কিনে খাওয়া অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। খোদ মাংস ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে, গোখাদ্যের দাম, গরু ক্রয়-বিক্রয়ে অনিয়ম ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকাতেও বিক্রি করা সম্ভব। অথচ বাজারে কিনতে হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি দরে।
এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত মাসে ১৯০ টাকা কেজি দরে কেনা গেলেও এখন ২৪০ টাকার নিচে মিলছে না। কোথাও কোথাও ২৬০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগির দাম এখন ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা। এক মাস আগে যেখানে ৩০০ টাকাতেও পাওয়া গেছে এ মুরগি। অপরদিকে গরুর মাংসের দাম শবেবরাতের আগেও প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা ছিল। সেখানে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া খাসির মাংসের কেজি এখন ১ হাজার ১০০ টাকা। গত মাসে যা এক থেকে এক হাজার ৫০ টাকায় কেনা গেছে।
মাংস ব্যবসায় নানা অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন খোদ মাংস উৎপাদনকারীরাই। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় পোলট্রি খামারিরাই জানান, খামারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনে খরচ বর্তমানে ১৬০ থেকে ১৬৭ টাকা পর্যন্ত এবং করপোরেট পর্যায়ে এ খরচ আরও কম; ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা কেজি।
কথা হলে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে। তাই আজ এক দাম তো কাল আরেক দাম। অন্যদিকে প্রান্তিক খামারিদের হাতে যখন মুরগি থাকে, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দাম কমিয়ে দিয়ে আমাদের ধ্বংস করে দেয়। আর যখন আমাদের হাতে পণ্য থাকে না, তখন তারা দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি লাভ করে। গুটিকয়েক বড় করপোরেট কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় মুরগির বাজার এখন অস্থিতিশীল।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সিন্ডিকেট, করপোরেট গ্রুপ ও এসএমএসের কথা বলা হচ্ছে, আমরা তা খতিয়ে দেখব। আমাদের কাছে আগেও এই বিষয়গুলো এসেছে। আমরা মনে করি, আলোচনার পরে নিঃসন্দেহে মুরগির দাম পড়তির দিকে থাকবে। এরপরও যদি দেখা যায় কাজ হচ্ছে না, সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে হয়তো আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে পারে।’
এদিকে গরুর মাংসের বাজার নিয়ে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব বলেন, মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। অবৈধভাবে, পাচার হয়ে আসা মাংস ও গরু সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার নতুন যুক্ত হয়েছে। আমাদের মত নিয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। একাধিক মন্ত্রণালয়ের বদলে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পশুপালন উন্নয়ন কার্যক্রম থাকতে হবে। শোরুমে গরু পালন করে কোরবানির চাহিদা মেটানো যেতে পারে, কিন্তু সারা বছরের চাহিদা মেটানো যায় না। চর অঞ্চলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি সহজ কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। গরুর হাটে ইাজারাদারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, পরিবহনসহ অন্যান্য চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। এসব করা গেলে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে ৫০০ টাকায়ও গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব।