রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রূপসী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এক ছাত্র সাধারণ কোটায় বৃত্তি লাভ করে। কিন্তু সংশোধিত ফলে তার বৃত্তি বাতিল হয়ে গেছে। এ স্কুলের শিক্ষকরা বলেন, শিশুটির কী দোষ ছিল। প্রিয় সন্তানের মন ভেঙে যাওয়ায় পরিবারেও নিরানন্দ। যেন পরিবারজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বুধবার রাতে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রশাসন দুঃখ প্রকাশ করলেও শিশুদের মনের ক্ষত সারবে কী করে? কোন ভাষায় সান্তনায় বন্ধ হবে সন্তানের কান্না। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কে কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকটি শিশুর পরিবারেও একই শোকের ছায়া পড়ছে। এভাবে সারাদেশে হাজার হাজার শিশুর মন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে চরম অব্যবস্থাপনায় ২০২২ সালের প্রাথমিকের বৃত্তি ফল স্থগিত আর পুনঃপ্রকাশের কারণে।
সংশোধিত বৃত্তির ফল প্রকাশের পর বুধবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেক অভিভাবক। সন্তানের সাফল্যের ফল পেয়ে যেসব পিতা-মাতা লিখেছিলেন, ফল পরিবর্তনে বৃত্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ হয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন তাদের অনেকে। শিক্ষক এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তির্যক মন্তব্য করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে। দুই দফায় ফল প্রকাশের কারণে ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটি কত- অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় থেকে সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানায়নি।
জানা গেছে, রাজধানীর লালবাগের নবাবগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ফল প্রকাশে ৫ জন বৃত্তি পায়। সবাই মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল)। কিন্তু সংশোধিত ফল প্রকাশের পর এই বিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। যাদের মধ্যে ১৬ জন মেধা কোটায় । আর একজন পেয়েছে সাধারণ কোটায়। উল্টো চিত্র রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম প্রকাশিত ফলে একজন ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত ফলে দেখা গেল বিদ্যালয় থেকে কেউই বৃত্তি পায়নি। শুধু এ দুটি বিদ্যালয়ই নয়, সংশোধিত ফলে সারাদেশেই এ রকম পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হওয়ায় অনেক বিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা হেরফের হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেকেই আগে বৃত্তি পেলেও সংশোধিত তালিকা থেকে বাদ গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন অভিভাবক লিখেছেন- ‘গত রাতে যখন সংশোধিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয়, তখন আমার মেয়ে ঘুমে। সকালে মেয়েকে জানালাম তার বৃত্তি না পাওয়ার কথা। তাতে তার অনেক মন খারাপ হয়। কারণ মেয়েটির পরীক্ষা এত ভালো হয়েছিল যে সে খুব কনফিডেন্ট ছিল বৃত্তি পাবে। পরে মেয়েকে জানালাম তার কাজিন আনিশা (চেয়ারম্যান ভাইয়ের মেয়ে) ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। তখন মেয়েটা এক গাল হেসে ওঠে এবং তার মন খারাপ কিছুটা দূর হয়। এটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। কারণ, কিছু মা-বাবা ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতার নামে এমন শিক্ষা দেয়, নিজে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য অন্যের খারাপ রেজাল্ট কামনা করে। আমার মেয়ের মধ্যে এই মানসিকতা তৈরি হয়নি দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে।’
বৃত্তির ফল সংশোধনে কেউ বাদ পড়া এবং যোগ করা এসবের কারণে একদিকে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে শিক্ষার যে সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা বিরাজমান তারই চিত্র ফুটে উঠছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এতটুকু বয়সের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষানির্ভর লেখাপড়া থেকে আমরা বের হতে পারছি না। শিশুদের লেখাপড়ার কোনো আনন্দ নেই। শিক্ষার লক্ষ্য শুধু জিপিএ পাওয়া। অভিভকরাও দৌড়াচ্ছেন কোচিং সেন্টারে।’
কারিগরি ত্রুটির দোহাই দিয়ে স্থগিত করা বৃত্তির ফলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক উত্তর কুমার দাশ বলেন, ২০০৯ সালে সর্বশেষ এ ধরনের বৃত্তির ফল তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ ১২ বছর পর এবার প্রায় একই ধরনের বৃত্তির ফল তৈরি হয়েছে। এবার বিষয়সহ বেশ কিছু জিনিস নতুন ছিল। কোডিং সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এমনটি হয়েছে। তালিকায় নাম আসার পর যারা বাদ পড়েছে তারা স্বাভাবিকভাবে কষ্ট পাবে?এটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে হাজার হাজার শিশুর মন ভেঙেছে- তার জবাব দেওয়ার মতো কি এই দেশ-সরকার বা রাষ্ট্রে কেউ আছে? সব কিছু নিয়ে তামাশা করতেই হবে। এতটাই উদাসীন!’ এই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করলেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু। তিনি বলেন, এটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা করা ঠিক হয়নি। নতুন করে ফল ঘোষণা হলে যারা বাদ পড়েছে তাদের মন ভেঙে গেছে। তাদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি তৈরি হবে। ভবিষ্যতে পড়ালেখায় তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ পেছনের দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ঘটনা জন্ম কিনা সেটিও খোঁজা উচিত তদন্ত কমিটির।’
তবে প্রাথমিকের বৃত্তির ফল নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে। এ ফল কেলেঙ্কারির ঘটনায় কোনো কর্মকর্তার গফিলতির প্রমাণ মিললে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, যদি কারও অপরাধ প্রমাণ হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল কেলেঙ্কারির নেপথ্যে রয়েছে কর্মকর্তাদের অদক্ষতা। তাদের ভুলেই সাড়ে ৮২ হাজার শিক্ষার্থী নির্বাচনে ভুল হয়েছে। ফলে পরীক্ষা না দেওয়া শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ফল কেলেঙ্কারির কারণ খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গঠন করা হয়েছে কমিটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, ফল তৈরির কারিগরি ত্রুটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফল তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের পর জেলা শিক্ষা অফিসে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে কোড দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষকরা সেই খাতা মূল্যায়ন করেন। ফলে কার খাতা কোনটি তা বোঝা যায় না। কিন্তু মূল্যায়নের পর প্রাপ্ত নম্বর কোড অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বরে যোগ হয়। শেষের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডিকোডিং। এই কোডিং ও ডিকোডিং প্রক্রিয়ায় ভুল হয়েছে। ঝিনাইদহের শৈলকুপাসহ কয়েকটি উপজেলায় সব শিক্ষার্থীকে একই কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে বলে ডিপিইর কম্পিউটার সেলে ধরা পড়েছে। এ কারণে সারাদেশের ফল পুনরায় যাচাই করার জন্য ফল স্থগিত করা হয়।
স্থগিত হওয়ার পর সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয় বুধবার রাতে। এতে দেখা যায়, এ বছর প্রাথমিকে ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে বৃত্তির ফল প্রকাশ করা হয়েছিল।