যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জোরালো সম্পর্কের পাশাপাশি মস্কোর সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় ঢাকা। বাংলাদেশি পণ্যের সব থেকে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। তা ছাড়া বাংলাদেশে দেশটির ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত জ্বালানি, সমরাস্ত্র ও পরমাণু শক্তি সম্পর্কিত। কিন্তু ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঢাকার নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
সম্প্রতি এক রুশ জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেয়ায় ঢাকা-মস্কোর সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। গত মঙ্গলবার নজিরবিহীনভাবে মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আন্দ্রে রোদেনকো।
রাশিয়া মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই উরসা মেজর নামের জাহাজটিকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়নি ঢাকা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে সরাসরি রুশ অসন্তোষের কথা জানিয়ে আন্দ্রে রোদেনকো বলেন, পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এ আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে হয়েছে। এদিকে রাষ্ট্রদূতকে তলবের ঘটনায় প্রতিবেদন চেয়েছে ঢাকা। আজ (বৃহস্পতিবার) আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
উল্লেখ্য, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল উরসা মেজর জাহাজের। তবে জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে জানার পর সেটি বন্দরে ভেড়ানোর অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, মঙ্গলবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানের সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেন দেশটির উপমন্ত্রী আন্দ্রে রোদেনকো। মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, উরসা মেজরকে বাংলাদেশকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া ঐতিহাসিক সম্পর্ক থেকে সরে আসা। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপ আছে বাংলাদেশের ওপর। তারা বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে নিতে মরিয়া। এরপরও বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে।
রাষ্ট্রদূত তলবের ঘটনায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলবের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছি। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখব। এখানে শুধু এটি নয় (তলব), দ্বিপক্ষীয় আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমাদের নীতিগত অবস্থান থেকে যখন যেখানে ভোটের যে ধারা যেমন হওয়া উচিত, সেভাবে করেছি। খুব শিগগির সাধারণ পরিষদে (জাতিসংঘের) আরেকটি প্রস্তাব আসছে। সেটা নিয়ে আমরা বিবেচনা করছি।’
এর আগে গত ডিসেম্বরে গুমের শিকার এক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সে সময় এমন হয়রানির বিষয়ে কড়া বিবৃতি দেয় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলবের ঘটনাও ঘটে। ওই বিবৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধেও জড়ায় ওয়াশিংটন-মস্কো।
গত ২০ ডিসেম্বর সকালে উরসা মেজর জাহাজের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এক কূটনৈতিক পত্রে জানানো হয়, স্পার্টা ৩ নামের একটি জাহাজের রং ও নাম পরিবর্তন করে এটি পাঠানো হয়েছে। স্পার্টা ৩ জাহাজের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাহাজটিতে পণ্য ওঠানো-নামানো, জ্বালানি সরবরাহ, নাবিকদের যে কোনো ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হলে বাংলাদেশ সমস্যায় পড়তে পারে বলে জানানো হয় ওই চিঠিতে।
এরপর ২০ ও ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় রুশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুটি চিঠি পাঠায়। দুই চিঠিতেই ওই জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুরোধ জানায় রাশিয়া। অনুমতি না দিলে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাবের হুশিয়ারিও দেয়া হয়। এরপরও অনড় অবস্থান নেয় ঢাকা।
২২ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মো. খুরশেদ আলমের দপ্তরে ডেকে ওই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। পরে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত সরকারের নানা পর্যায়ে আলোচনা করেও অনুমতি আদায়ে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে মস্কো জানায়, ওই জাহাজ ভারতের হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশে তা পাঠিয়ে দেবে। ভারত সাধারণত জাতিসংঘ ছাড়া কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত মেনে চলে না। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা বেশ কিছু রুশ জাহাজ ভারতে পণ্য খালাস করেছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে এবার উরসা মেজরের ক্ষেত্রে। ফলে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে কেন্দ্রে এনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিবৃতি, টুইট, ব্রিফিং সবকিছুর নেপথ্যে কাজ করেছে ভূরাজনীতি।