ভালোবাসা দিবস : ইসলাম কী বলে?

Slider সারাদেশ


বর্তমান বিশ্বে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে উদযাপন করা হয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ দিবসটিকে খুবই আড়ম্বর, জাঁকজমকপূর্ণ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। এর সূচনা মধ্যযুগে হলেও নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার ঘটে। বাংলাদেশের মানুষ আশির দশকেও এ দিবসটির সাথে ছিল অনেকটাই অপরিচিত। তবে নব্বই দশক থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় ও মিডিয়ার কল্যাণে এ দেশের যুবসমাজের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।

ভালোবাসা দিবসের উৎস নিয়ে নানা মত ও ঘটনা প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তা হলো- লুপারকালিয়া নামে প্রাচীন রোমে এক উৎসব ছিল, যা ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অবধি উদযাপিত হতো। যে উৎসবে নারী-পুরুষ সমানতালে মদ পান করত এবং লটারির মাধ্যমে সঙ্গী বেছে নিয়ে তার সাথে একান্তে মিলিত হতো। অতঃপর রোমানরা যখন তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্মে ধাবিত হচ্ছিল তখন তারা প্রাচীন দেবীর নামে লুপারকালিয়া উৎসবকে মেনে নিতে পারছিল না। আবার উৎসবটি খুব জনপ্রিয়ও ছিল বলে ছেড়েও দিতে পারছিল না। অবশেষে উৎসবটিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করে উদযাপন করত। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নোয়েল লেন্সকি বলেছেন, লুপারকালিয়া উৎসবে পুরুষরা দেবী লুপারকাসের নামে একটি ছাগল আর একটি কুকুর বলি দিত। তারপর মৃত ছাগল বা কুকুরের চামড়া দিয়ে উৎসবে অংশগ্রহণকারী মেয়েদের বেদম প্রহার করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এ প্রহারের কারণেই মেয়েদের প্রজননক্ষমতা বাড়ে।

এ ছাড়া এ দিবসের সূচনা ইতিহাস সম্পর্কে আরো যা জানা যায় তা হলো- ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিবাহিত পুরুষদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে এবং আইন জারি করে- তার সাম্রাজ্যে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কারণ, বিবাহিত সেনারা স্ত্রী-

সন্তানদের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর ঝুঁঁকি নিতে চাইত না। কিন্তু রোমান এক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের ন্যায়ভ্রষ্ট নিয়মের প্রতিবাদ করে ও বিয়ে করে। এ খবর সম্রাট ক্লডিয়াসের কাছে পৌঁছলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করে মৃত্যদণ্ড দেয়। আর সে মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করা হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ দিবসটিকে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

আবার কারো কারো মতে, ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন খ্রিষ্টান পাদ্রি ও চিকিৎসক। সে সময় রোমানরা ছিল দেব-দেবীর অনুসারী। ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আর বন্দী অবস্থাতেই ভ্যালেন্টাইন জেলারের অন্ধ মেয়ের চোখের চিকিৎসা করে। ফলে মেয়েটি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে লিখে যায় Love From your valentine. আর ওই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। এই হলো মূলত ভালোবাসা দিবসের সারসংক্ষেপ ইতিহাস।

হ্যাঁ, প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এসব মানবিক গুণ আছে বলেই এখনো টিকে আছে এ নশ্বর পৃথিবী। আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেন- ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম, আয়াত-২১) অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে ওই সব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার করো না, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদের দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদের ও তাদের আহার দিই, নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য। যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, ন্যায়ভাবে ছড়া তাকে হত্যা করো না; তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা বোঝো।’ (সূরা আন’আম, আয়াত-১৫১)

আর এ কথা স্পষ্ট, বর্তমানের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস নামে আমাদের সমাজে যেই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নগ্নতার উন্মুক্ত প্রদর্শন চলে তা একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন, সভ্য রুচিশীল মানুষের জন্য পালন করা শোভা পায় না। তা ছাড়া এটি তো একটি বিজাতীয় উৎসবও। দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য, এই উৎসবে আমাদের সমাজের যুবক-যুবতীরা সব বুঝে শুনেও পালন করে, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কলেজ, ভার্সিটি ও মধ্যম স্তরে পড়ালেখা করে। অথচ এখানে অংশগ্রহণ করা একজন মুসলমানের জন্য কখনোই জায়েজ নেই, হারাম। কারণ, নবীজী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির আচার-আচরণে, কৃষ্টিকালচারে সামঞ্জস্যতা অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত বা অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।’ (আবু দাউদ-৪০৩১, মিশকাত-৪৩৪৭)

মনে রাখতে হবে, এসব হৈ-হুল্লোড়, আতশবাজি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অবাধ ঘোরাফেরা ও পার্কসহ সব জায়গায় অশ্লীলতা প্রদর্শনের জন্যই পৃথিবীতে বালা-মুসিবত আসে, মরণব্যাধি মহামারী আসে। কারণ, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে- তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৩৩২) তাই মহান আল্লাহ তায়ালার গজব থেকে বাঁচতে হলে গজবের কারণ তথা লুপারকালিয়া ও সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে এবং তা পালন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। আর অন্যদেরও তা পালনের প্রতি নিরুৎসাহিত করতে হবে।

অতএব, আমাদের দ্বীন ও ঈমান-প্রিয় আখিরাতের অন্তহীন জীবনের প্রতি বিশ্বাসী সুপ্রিয় মু’মিন-মুসলিম ভাইবোনেরা! ভালোবাসা কোনো পর্বীয় বিষয় নয়। এটি মানবজীবনের সুখ-শান্তির জন্য একটি জরুরি সার্বক্ষণিক মানবিক উপাদান। সুতরাং আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সৌহার্দ বৃদ্ধির জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর শেখানো পন্থাগুলো সার্বক্ষণিক অবলম্বন করতে সচেষ্ট হই। সেই সাথে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নামে প্রচলিত ঈমান বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে নিজে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট হই এবং অন্যকেও বিরত রাখার চেষ্টা করি।

লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ (ইফতা), দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাঙ্গাইল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *