যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতনের মামলায় রাজশাহী রেঞ্জের এসএসপি রুবেল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ১১ জানুয়ারি এই আদেশ জারি হয়। তবে এএসপি রুবেল এখনো কর্মরত। আজ বুধবারও তিনি একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন বলে নিজেই জানান।
রুবেল হক এখন পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত।
তবে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেদিন সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি হয়েছে, সেদিন থেকেই তা কার্যকর।’
মামলা সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেটে জানা গেছে, ৩৬তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশের এএসপি পদে চাকরিতে যোগ দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রুবেল হক। চাকরির পর বিয়ে করেন নওগাঁর সায়মা সুলতানা মিমিকে। ২০২১ সালের ৩১ মে তাদের বিয়ে হয়। দেনমোহর ছিল ৪ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। বিয়ের সময় নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন রুবেল। পরে স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে যান।
বিয়ের পর স্ত্রীর কাছে ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। টাকা পেতে নির্যাতন চালান স্ত্রীর ওপর। ওই সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্যাতনের কথা জানান সায়মা। পরে বদলি হয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আসেন রুবেল। কিন্তু সেখানেও নির্যাতন চলতে থাকে। নির্যাতনের মুখে সায়মা থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ নেয়নি।
পরেরবার নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯৯৯-এ ফোন করেন সায়মা। বাড়িতে পুলিশ যায়। কিন্তু পুলিশেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে সায়মা আদালতে মামলা করেন। সায়মার আবেদনে এ মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়।
টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রূপন কুমার দাশ গত ১৮ অক্টোবর টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সায়মা সুলতানা মিমি জানান, বিয়ের আগেই খরচ হিসেবে ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন রুবেলের বাবা। তবে তারা রুবেল হকের নামে সোনালী ব্যাংকের ইব্রাহিমপুর শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল ২ লাখ টাকার চেক দেন। প্রমাণ রেখে টাকা দেওয়ায় ভীষণ চটেছিল রুবেলের পরিবার। পরে বিয়ের দিন আরও ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বিয়ের উপহার ও অন্য সবসহ খরচ হয় আরও ৯ লাখ টাকা। তারপরও রুবেলের দাবি কমেনি। বিয়ের পর একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৫০ লাখ টাকা দাবি করে আসছিলেন। দিতে না পারার কারণে তার ওপর অমানষিক নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি আদালতে মামলা করেন। এ মামলায় রুবেলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। তবে তিনি এখন জামিনে আছেন।
সায়মা সুলতানা মিমি আরও জানান, তিনি এখন আলাদা থাকেন। তবে তাদের এখনো ডিভোর্স হয়নি। গত বছরের ২৯ আগস্ট তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। আদালতে মামলা করেন ৬ সেপ্টেম্বর। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর রুবেলের বাবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে উল্টো ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির অভিযোগে মামলা করেন। এতে সায়মাসহ তার পরিবারের পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় সমন জারি করেন আদালত। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সায়মা আদালতে হাজির হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি কারাভোগ করেন। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। সায়মার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
সায়মা বলেন, ‘রুবেল হকের নির্যাতনের শিকার হয়ে গত বছরের ৯ ও ১০ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি ছিলাম। ১১ আগস্ট ছিল শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা। তাই অসুস্থ শরীর নিয়েও আমি নওগাঁ যাই। তারপর ১২ আগস্ট গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু রুবেলের বাবা জারজিস আলী যে মামলা করেছেন, তাতে ঘটনার তারিখ দেখানো হয়েছে ১২ আগস্ট। এটি পুরোপুরি মিথ্যা। শুধুমাত্র রুবেলের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে বাধ্য করতেই এই পাল্টা মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা-২ শাখার সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে রুবেল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে আদেশের কপি গত সোমবার পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে এসে পৌঁছায়।
আজ সকালে ফোন করা হলে রুবেল হক নিজেই বিষয়টি জানিয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলার কারণ জানতে চান। স্ত্রী নির্যাতন ও বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কথা বলব না। এখন প্রশিক্ষণে আছি।’
বিকেলে এসএসপি রুবেল আমাদের সময়কে বলেন, ‘মামলায় জামিন নিলে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ হয়। এটিই নিয়ম। আমি আদেশমূলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছি। এটিও ব্যক্তিগত বিষয়। আদালতের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে।’