দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পের ভিত তৈরি হয়েছে যাদের অবদানে, রাজ্জাক তাদের অন্যতম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তাকে দিয়েছে ‘নায়করাজ’ উপাধি। চার দশকে নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আজ তার জন্মদিন। ১৯৪২ সালের এই দিনে অবিভক্ত ভারতের কলকাতার কালীগঞ্জের নাকতলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেঁচে থাকলে তার ৮১ বছর পূর্ণ হতো। প্রকৃত নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। মাত্র আট বছর বয়সেই বাবা আকবর হোসেন ও মা নিসারুন্নেসাকে হারান। তবে তিন ভাই, তিন বোনের সংসারে বড়রা রাজ্জাককে বুঝতেই দেননি বাবা-মায়ের শূন্যতা।
রাজ্জাক যে পাড়ায় থাকতেন, সে পাড়ায়ই থাকতেন ছবি বিশ্বাস (কাঞ্চনজঙ্ঘা, জলসাঘরসহ অসংখ্য বাংলা ছবির শক্তিমান অভিনেতা), সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়শিল্পীরা। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে আবৃত্তি শেখাতেন পাড়ার শিশু-কিশোরদের। রাজ্জাকও তার কাছে আবৃত্তি শিখেছেন। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্কুলেই একটি নারীবর্জিত নাটক করতে চাইলেন, নাম ‘বিদ্রোহী’। স্কুলের মেয়েরাও রাজ্জাকের অভিনয়ের তারিফ করল। তাতে অভিনয়ের প্রতি মনোযোগী হলেন।
রাজ্জাকের আইডল ছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজ্জাক ঠিক করলেন তিনি বোম্বে চলে যাবেন। পীযূষ বোস পরামর্শ দিলেন, ‘ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাও।’ মাইগ্রেশন করে খুলনা বর্ডার দিয়ে শিমুলিয়া হয়ে ঢাকায় চলে এলেন রাজ্জাক। ততদিনে তিনি বিয়ে করেছেন (১৯৬২), স্ত্রী রাজলক্ষ্মী ও আট মাসের সন্তান বাপ্পারাজকে সঙ্গে করে ঢাকায় এলেন। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। ঢাকার কমলাপুরে ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। আয়রোজগার নেই। যে টাকা এনেছিলেন, তাও ফুরিয়ে গেল।
অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে হয়নি, পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ‘কাগজের নৌকা’, ‘কাগজের বৌ’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন। ভালো চরিত্রের জন্য কেউ তখনো তাকে ডাকেনি। এরই মধ্যে দেখা হলো জহির রায়হানের সঙ্গে। গুণী এই নির্মাতা নিজের পরবর্তী ছবি ‘হাজার বছর ধরে’-এর নায়ক হিসেবে রাজ্জাককে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সে ছবিটি আর হয়নি। পরে ‘বেহুলা’ ছবির নায়কের চরিত্রে নিলেন রাজ্জাককে। পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এর পর জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবি করে পেলেন সাত হাজার টাকা। রাজ্জাক পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো মাটি পেলেন।
রাজ্জাক অভিনীত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি মাইলফলক। তিনি এরই মধ্যে ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আবির্ভাব’, ‘এতটুকু আশা’, ‘কাঁচ কাটা হীরা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ইত্যাদি ছবি করে ফেলেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও রাজ্জাক ছিলেন খ্যাতির শিখরে। ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’-এর মতো ছবি করেছেন। নারায়ণ ঘোষ পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটির কথাও মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে।
অভিনয় ছাড়া পরিচালনাও করেছেন রাজ্জাক। তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘অনন্ত প্রেম’। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ছয়টি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৫ সালে সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।