ঢাকা: তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তিসহ মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা এবং দুধকুমারের পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত সমঝোতা যত দ্রুত সম্ভব করা হবে বলেও অঙ্গীকার করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া এককভাবে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবে না ভারত। ঢাকা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একইসঙ্গে
নরেন্দ্র মোদির সফরের শেষ দিনে রোববার প্রকাশিত ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণায়ও এসব কথা বলা হয়েছে।
দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সামুদ্রিক অর্থনীতি, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। এই ঘোষণার নাম দেওয়া হয় ‘নতুন প্রজন্ম, নয়া দিশা’।
তারা মনে করেন, সার্বভৌমত্ব, সমতা, বন্ধুত্ব, আস্থা ও পরস্পরের জনগণের স্বার্থে এবং এ অঞ্চলের সামগ্রিক কল্যাণের ভিত্তিতে ফলপ্রসূ, পরিপক্ব ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, আলোচনায় নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং শেখ হাসিনা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। দু’দেশের সম্মতিতে সুবিধাজনক সময়ে শেখ হাসিনা ভারত সফর করবেন।
রোববার বিকেলে সোনারগাঁও হোটেলে এই যৌথ ঘোষণা পাঠ করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর। পরে এটি বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়।
যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের এস জয়শঙ্কর বলেন, ভারত সব সময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে। তবে ভারত দৃঢ়ভাবে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরোধিতা করে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে দু’দেশই জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে।
যৌথ ঘোষণায় যা রয়েছে: যৌথ ঘোষণায় নরেন্দ্র মোদির দু’দিনের সফরে স্বাক্ষরিত ১৯টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক, প্রটোকল স্বাক্ষর এবং স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দলিল বিনিময় এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়ের কর্মসূচির বিবরণ তুলে ধরা হয়। দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসা নানা প্রসঙ্গ এবং প্রতিশ্রুতির বিবরণও দেওয়া হয় এতে।
ঘোষণার ১৯ দফায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১১ সালের সমঝোতার আলোকে দ্রুত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ করেন। আলোচনায় ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গটিও উঠে আসে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমর্থন নিয়ে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করা হবে। ২০১১ সালের ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অব ডেভলপমেন্ট কো-অপারেশন’-এর আর্টিকেল-২ অনুযায়ী দু’দেশে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আবারও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ের কারণে এ মুহূর্তে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প এগোচ্ছে না। একইসঙ্গে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনো কার্যক্রম ভারত নেবে না এবং বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানান, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য পূরণে ভারতের সহযোগিতা চান তিনি। জবাবে নরেন্দ্র মোদি ভারতের কোম্পানিগুলোকে আরও সহজে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ করেন।
তিনি ভেড়ামারা-বহরমপুর গ্রিডের মাধ্যমে বর্তমানে ভারত থেকে আসা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এক হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা এবং আরও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।
এছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাংগিয়া-রাওয়াতা থেকে মুজাফফরনগর হয়ে বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়া এলাকার সুবিধাজনক স্থান দিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (৮০০ কেভি) এইচভিডিসি মাল্টি-টার্মিনাল বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করার ব্যাপারে দু’দেশের ঐকমত্যকেও স্বাগত জানান দুই প্রধানমন্ত্রী। এই গ্রিড দিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যাবে, যা থেকে বাংলাদেশও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিতে পারবে।
রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়েই উৎপাদনে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন দুই নেতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, পরিবেশ রক্ষা করে বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে ভারত করিডোর দেবে বলে জানান তিনি।
দু’দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তেল, গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রেও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দিতেও সম্মত হয়েছে ভারত।
দুই প্রধানমন্ত্রী নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে ডিজেল পরিবহন সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারককে স্বাগত জানান। সমঝোতা অনুযায়ী শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ডিজেল পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য দ্রুত দু’দেশের যৌথ কোম্পানি গঠনেও তারা সম্মত হন।
তারা সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিতদের নির্দেশনা দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং সীমান্ত এলাকা ঘিরে অপরাধ দমনে আরও কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে তারা সম্মত হন। মানব পাচার এবং জাল মুদ্রা প্রতিরোধে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরেও সম্মত হয়েছেন দুই নেতা।
যৌথ ঘোষণায় আরো বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা সমুদ্রভিত্তিক ব্লু-ইকোনমি গড়ে তুলতে দু’দেশের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার বিষয়েও একমত হন। বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন এবং দু’দেশের ভেতরে নতুন সড়ক ও রেল যোগাযোগ চালুর মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে বলেও মনে করেন তারা। এ পদক্ষেপ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক চালুর ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ থেকে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আমদানিতে দু’দেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মধ্যে চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন দুই নেতা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দু’দেশের সহযোগিতার সম্পর্ক আগামীতে আরো নিবিড় এবং দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক বেশি সহায়ক হবে বলেও আশা করেন তারা।
দু’দেশের মধ্যে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর ব্যাপারে তারা একমত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, গবেষকদের ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানান। তারা দু’দেশের জনগণের মেধা, জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি আন্তঃসম্পর্ক জোরদারেও গুরুত্ব দেন। অচিরেই ভারতের দূরদর্শন এবং বাংলাদেশের বিটিভি ‘প্রসার ভারতী’র ডিটিএইচ সেবায় যুক্ত করার ব্যাপারেও একমত হন। এর ফলে দু’দেশের জনগণের সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বন্ধন দৃঢ় হবে।
দুই নেতা মনে করেন, এ সময় থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন যুগে, নতুন সম্ভাবনায়, নতুন মাত্রায় প্রবেশ করল। বিশেষ করে ৪২ বছর ধরে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন বিশ্বের জন্য একটি বড় উদাহরণ বলে তারা মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল পাস করায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সব রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানান। নরেন্দ্র মোদি বলেন, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছে। ভারতের জনগণ সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে থাকবে।