সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমল থেকে সাফল্যের ধারেকাছে নেই বিএনপি। সেই থেকে মামলা, গ্রেপ্তার ও দলের অভ্যন্তরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দলটিকে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট ঠেকানোর ব্যর্থ আন্দোলন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলায় সাজা হলে আইনি জটিলতায় দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক মহলের বিএনপির প্রতি আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দলীয় প্রধান কারাবন্দি হলেও তাকে মুক্ত করতে দৃশ্যমান কোনো আন্দোলনও গড়তে পারেনি দলটি। সে জায়গা থেকে ২০২২ সালে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে সাফল্য পেলেও দলের মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে চাপেও পড়ে দলটি।
বিএনপির এই ঘুরে দাঁড়ানোকে ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনা করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ফিনিক্স পাখি এমন ছিল- এটাকে হত্যা করলে তার একেক ফোঁটা রক্ত থেকে হাজার হাজার ফিনিক্স পাখি সৃষ্টি হতো। সেই গ্রিক উপাখ্যান, সেই ফিনিক্স পাখির মতোই যত বেশি নির্যাতন, গুম, খুন করা হয়েছে; বিএনপি আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বিএনপির সমর্থন আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।’
ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, গত ১৪ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ৬ শতাধিক গুম, এক হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা, ৩৭ লাখ বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াসহ নানাভাবে নির্যাতন করেছে। কিন্তু বিএনপিকে দমন করা যায়নি।
বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে এটা ঠিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য কখনো সম্মানের ছিল না। ইতিহাস বলে, কোনো কোনো বিজয় অসম্মানও ডেকে আনে; কখনো কখনো পরাজয়ও সম্মানের হয়। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় কিন্তু ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের মতো একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে এখনো স্মরণ করা হয়।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকার বিরোধী দলকে দমন করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। এ অবস্থায় ২০২১ সালের শেষের দিকে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রহীনতা’ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব জোরালোভাবে প্রশ্ন তুললে সরকার বেকায়দায় পড়ে। এ ছাড়া সরকারের লোকজনদের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচার, করোনাকালে বিভিন্ন কেনাকাটায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতির খবর দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় প্রকাশ হতে থাকলে সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে যায়।
এসব সমালোচনার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা সরকারের কাছ থেকে মানুষ পায়নি। এ অবস্থায় কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার জন্য বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ওপরও দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে চাপ আসতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দল পুনর্গঠন, যুগপৎ আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় এবং দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে কর্মসূচিসহ আন্দোলনের গতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি করে করে দলটি ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকে।
বিদ্যুতের লোডশেডিং চরমমাত্রায় দেখা দিলে এর প্রতিবাদে জুলাই মাসের শেষ দিকে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। কেন্দ্র ঘোষিত ৩১ জুলাই ভোলায় কর্মসূচি করতে গিয়ে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুর রহিম ও ছাত্রদল নেতা নূরে আলম নিহত হন। এরপর ৫ আগস্ট রাত ১২টা থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করে সরকার। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে মানুষের সাড়া পেয়ে বিএনপি ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তাতে সবকটি কর্মসূচিই সফল হয়। আর কর্মসূচিগুলোতে ১৫ জন নেতাকর্মী নিহত হলে তা দলটির তৃণমূল ও সমর্থকরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, সরকার সাংগঠনিকভাবে দুর্বল না হলেও ‘অর্থনৈতিক ও মানসিক’ চাপে পড়লে সুযোগটিকে কাজে লাগায় বিএনপি। গত ২২ আগস্ট জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে জেলা, মহানগর, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচি করে বিএনপি। দীর্ঘদিন পর রাজধানী ঢাকায় ১৬টি স্পটে সমাবেশ করে। এরপর ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ করে। ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে ৭ ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ সাড়ে চারশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন পর্যন্ত তাদের কারও জামিন হয়নি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহান বলেন, গণপরিবহন বন্ধ, বিভিন্ন স্থানে হামলা, নেতকার্মীদের গ্রেপ্তার করেও সরকার গণসমাবেশ ব্যর্থ করতে পারেনি। বরং যত বাধা দিয়েছে, নেতাকর্মীরা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। এই গণসমাবেশে দেশের সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করেছে, যা দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, গত ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা ঘোষণা এবং সাত এমপির একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা এবং গত ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা ঘোষণা দেয় বিএনপি। বছরব্যাপী আলোচনা, ধারাবাহিক বৈঠকের পর ঢাকা ও রংপুর বাদে অন্যান্য জেলা ও মহানগরে গত ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিল দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন মাঠে গড়ায়। ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা ও রংপুরের গণমিছিলের মধ্য দিয়ে বছরের শেষ কর্মসূচি করছে বিএনপি-সমমনা রাজনৈতিক দল।