নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে বেসরকারি স্কুলগুলো মানছে না সরকারি নিদের্শনা। এমনকি লাগামহীন ভর্তি ফি আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে কোনো কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ তদন্তে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে শিক্ষা প্রশাসন। একই সঙ্গে সারাদেশে সরকারি নির্দেশনা মেনে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে কিনা, তা নজরদারিতে গঠন করা হয়েছে মনিটরিং টিম। এর মধ্যে বেসরকারি স্কুলেও সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফির সঙ্গে টিউশন ফিও নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা। বেসরকারি স্কুলে ফি নির্ধারণ প্রক্রিয়া জটিল হলেও সদ্বিচ্ছা থাকলে তা সম্ভব বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
নতুন শিক্ষাবর্ষে অনলাইনে ডিজিটাল লটারি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি সম্পন্ন করা হয় গত ১৮ থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে স্কুলগুলোতে ভর্তি নেওয়া হবে ২২ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ প্রক্রিয়ায় ভর্তিতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণাল অভিযোগ আমলে নিয়ে চিহ্নিত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- গ্রিনফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ (নন এমপিওভুক্ত), হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, চেতনা মডেল একাডেমি, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট, বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, প্রিপারেটরি গ্রামার স্কুল, কসমো স্কুল, সামসুল হক খান উচ্চ বিদ্যালয়, বনফুল গ্রিন হার্ট আদিবাসী কলেজ, এস ও এস হারম্যান মেইনার কলেজ এবং শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এসব স্কুলের বিষয়ে চার উপসচিবের নেতৃত্বে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বেসরকারি স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজে (মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তর) শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত ভর্তি ফি ও অন্যান্য ফি (বেতন, টিউশন ফি, সেশন চার্জ) নেওয়ার বিষয়ে পাওয়া অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেবেন। এ ছাড়া সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি স্কুল এবং বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে গ্রহণ করছে কিনা, তা সরেজমিন যাচাইয়ের জন্য মনিটরিং টিম গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে কাজ করবে ১৬ মনিটরিং কমিটি। এ ছাড়া আটটি বিভাগীয় মনিটরিং কমিটি বিভাগীয় সদর জেলায়, ৫৫ জেলা মনিটরিং কমিটি জেলা সদর এবং উপজেলা মনিটরিং কমিটি উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া সরেজমিন নজরদারি করে মাউশিকে রিপোর্ট দেবে।
জানা গেছে, স্কুলগুলোয় সরকার নির্ধারিত সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০ টাকা, উপজেলা এলাকায় ১ হাজার টাকা, জেলা সদর এলাকায় ২ হাজার টাকা। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় ভর্তি ফি ৩ হাজার টাকার বেশি হবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত এমপিওভুক্ত স্কুল শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত আদায় করতে পারবে না। এ ছাড়া আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং ননএমপিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা নিতে পারবে।
ভর্তি নীতিমালায় বলা হয়েছে, উন্নয়ন খাতে কোনো প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। একই প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক ক্লাস থেকে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবছর সেশন চার্জ নেওয়া যাবে। তবে পুনঃভর্তির ফি নেওয়া যাবে না। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য ভর্তির সময়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট হিসাব খাতে জমা দিতে হবে।
তবে রাজধানীর কোনো কোনো স্কুলে ভর্তির সময় উল্লিখিত হারে টাকা নিলেও শিক্ষাবর্ষের দুই-তিন মাস পরে বিভিন্ন অজুহাতে অভিভাবকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ফি আদায় করে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। এ প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু আমাদের সময়কে বলেন, এখন অনেক স্কুলে সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফি নিলেও এক দুই মাস পরে তারা নানা অজুহাতে অভিভাবকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়। সরকার এখন নজরদারি করলে প্রকৃত তথ্য পাবে না। শিক্ষাবর্ষের মধ্যে কয়েকটি ধাপে ধাপে স্কুলগুলো নজরদারি করলেই আসল চিত্র পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। সরকারকে টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে। এখন স্কুল ভেদে মনগড়া টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। এর জন্য ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে স্কুলগুলো নিয়ে থাকে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে রাজধানীর মগবাজার ইস্পাহানি গালস্ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মারুফি খান বলেন, ‘প্রতি বছর স্কুলগুলো পুনঃভর্তি ফি অথবা সেশন চার্জ যে নামেই টাকা নিক, তা অযৌক্তিক নয়। কারণ একজন শিক্ষার্থীর সারা বছরের অনেকগুলো সেবার জন্য এই ফি ধার্য করে স্কুল। এখন কোন স্কুল কতটা সহনীয় পর্যায়ে নেয়, সেটা হলো বিষয়। এটা সরকার নির্ধারণ করবে কীভাবে? সব স্কুলে লেখাপড়ার মান, শিক্ষকদের বেতন, অবকাঠানো এক নয়। এ জন্য সরকার একটি নির্দিষ্ট মানদ- সূচকে গ্রেডিং করতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। সেই হিসেবে তারা কোন খাতে কত টাকা ফি নেবে, অন্যরা কী হারে ফি আদায় করবে, তার একটা রূপরেখা তৈরি করতে পারে। তবে এটি খুবই জটিল প্রক্রিয়া।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীকে বলেন, ‘সরকার শিক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানের অঙ্গীকার করেছে। তাই শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাসে বেসরকারি শিক্ষা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। সরকার কেন পারবে না? ভর্তি ফি যদি স্থান, স্তর হিসেবে বিভাজন করে নির্ধারণ করে দেওয়া যায়, তাহলে কেন টিউশন ফি নির্ধারণ করা যাবে না? বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার? অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আছে।
বেসরকারি স্কুলের টিউশন ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আলাপ করেই তা করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, ‘ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। টিউশন ফিও নির্ধারণ করে দিতে হবে। এটা ঠিক যে প্রতিষ্ঠান ভেদে তাদের ব্যয়ও ভিন্ন। এক্ষেত্রে সরকার যে পদ্ধতিতে ভর্তি ফি নির্ধারণ করেছে একইভাবে টিউশন ফিসহ অন্যসব ফির সর্বোচ্চটা নির্ধারণ করে দিতে পারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি স্কুলে ভর্তির লটারি ড্র অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানের মান এক না। আবার সব প্রতিষ্ঠান সমান সুযোগ দিতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের ফি কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। আমরা হয়তো কয়েকটা ধাপ নির্ধারণ করে দেব যে, এই এই সুবিধা দিলে এ পরিমাণ ফি নিতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে ওয়ার্কশপ করেছি। আসলে এটি করলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত নিয়েই করতে হবে। বেসরকারি খাতে কতটা ফি স্ট্র্যাকচার চাপিয়ে দিতে পারে, সেটিও দেখার বিষয়। আমরা নিয়ম করে দিতে পারি, কিন্তু যদি কেউ না মানে তাহলে তো লাভ হলো না। আমাদের পুরো স্ট্র্যাকচার নিয়ে কাজ করতে হবে। গতবছর এ নিয়ে আমরা একটা ওয়ার্কশপ করেছিলাম, এবারও তা করা যাবে। সামনের বছর এ বিষয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে পারি।’