ফরিদপুরের গ্রামগঞ্জে কোনো একসময় রাস্তার দুই পাশে, নদীর পাড়ে ও বসতবাড়িতে সারি সারি খেজুর গাছের দেখা মিলত। শীতের আগমনের আগে হেমন্তের মাঝামাঝিতেই এসব গাছ থেকে রস আহরণের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন গাছিরা। পিঠে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো খোল, তার মধ্যে গাছ কাটার ধারালো ছ্যান, তালের খোলা, পোড়া বালি। কোমড়ে দড়ির গোছা। কাঁধে বাঁশের মোটা চটার দুই ধারে থাকত রসে ভরা হাড়ি। শীত এলে এই দৃশ্য ছিল ফরিদপুরের গ্রামগঞ্জের চিরচেনা দৃশ্য।
তবে এই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। বিভিন্ন কাজে খেজুর গাছ কাটায় কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ। নতুন করে গাছ না লাগানোর পাশাপাশি গাছি পেশায় নতুনদের আগ্রহ কম থাকায় এমনটা হয়েছে। এই সুযোগে হাট-বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল গুড়ে। চিনির চেয়ে কয়েকগুন দাম বেড়ে বাজারে খেজুর রসের খাঁটি গুড় এক কেজি পাঁচ শ` থেকে ছয় শ` টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সারা দেশে যশোরের মতোই ফরিদপুরের খেজুরের রসের সুখ্যাতি রয়েছে। শীত এলে খেজুরের গাছগুলো ঝুড়ে যৌবনবতী করে গাছিরা। ধারালো কাঁচি দিয়ে গাছের ডগা ঝুড়ে নতুন বাকল বের করে গুঁজে দিতো রসের নল। সেখানে সন্ধ্যায় হাড়ি বসিয়ে পরদিন সকালে নামিয়ে আনত রসে ভরা হাড়ি। এরপর পথেঘাটে বিক্রি করতো সেই রস।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা যায়, ফরিদপুরে প্রায় ২০০ হেক্টর জমির ওপর প্রায় এক লাখ ২০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে প্রায় এক হাজার ৫৫০ টন রস সংগ্রহ হয়। যা থেকে প্রায় ২৫০ টন গুড় পাওয়া যায়। জেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ রয়েছে বোয়ালমারী ও নগরকান্দা উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার। এরপরে রয়েছে ভাঙ্গায় প্রায় ১৪ হাজার। সদর উপজেলাতেও এ সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। আর সালথা, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও সদরপুরে কমবেশি ১০ হাজারের কাছাকাছি ও চরভদ্রাসনে রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। তবে বাস্তবে খেজুর গাছের বর্তমান সংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম বলে মনে করা হয়।
শহরের ডোমরাকান্দির মো: এনামুল হোসেন ভিপি গিয়াস জানান, তিনি পরিচিতদের কাছে প্রতি কেজি খেজুরের খাঁটি গুড় চার শ` টাকায় বিক্রি করছেন এ বছর। খাঁটি গুড় পাঁচ শ` থেকে ছয় শ` টাকা দরে বিক্রিও হয় বলে জানান তিনি। তবে ভেজাল গুড় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র দেড়শো থেকে তিন শ` টাকায়। গুড় ছাড়াও খেজুর গাছের পাতা মাদুর ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জীবাংশু দাস বলেন, বিলুপ্তির হাত থেকে খেজুর গাছ রক্ষা করতে গ্রামের রাস্তার দুই পাশে ও পতিত জমিতে খেজুর গাছ রোপণ করেতে হবে। পাশাপাশি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে গাছিদের জীবনমান উন্নত করতে পারলে এ পেশার প্রতি তাদের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব।
সালথার সাংবাদিক নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, একসময় পুরো এলাকা জুড়ে খেজুর গাছের সমাহার থাকলেও এখন যদুনন্দী ও খারদিয়া গ্রাম ছাড়া কোথাও তেমন গাছের দেখা মিলে না। বেশিরভাগ গাছই ইটভাটায় পুড়ে ছাই হয়েছে। গাছিরাও পেশা বদল করে ফেলছেন। তবে বাজারে খেজুর গুড় বিক্রেতার অভাব নেই, সেগুলোর বেশিরভাগই ভেজাল।
রঘুয়ারকান্দী গ্রামের গাছি তৈয়ব মিয়া বলেন, গ্রামে খেজুর গাছ নেই বলে এখন আর গাছ ঝুড়েন না। আগে তিনি প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি গাছ ঝুড়তেন। তখন বাজারে গুড়ের দামও ছিল কম। এখন গরিব মানুষের পক্ষে খেজুরের গুড় কিনে খাওয়া সম্ভব না।
ভিন্ন কথা বলেন যদুনন্দী গ্রামের গাছি জয়নাল শেখ। তিনি জানান, তিনি এখনো প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি খেজুর গাছ কাটেন এবং এই রস জ্বালিয়ে তিন শ` কেজির মতো গুড় হয়। তবে কিছু লোক আমাদের থেকে গুড় কিনে তাতে চিনি ও রং মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে বলে শুনেছি।
ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়িরা জানান, ভেজাল গুড় তৈরির জন্য বড় মহল গড়ে উঠছে। তারা খেজুরের ঝোলা গুড় কিনে তার সাথে রং, আটা ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করেন। চিনির দাম কম হওয়ায় তারা এ সুযোগ নিচ্ছেন। দাম কম হওয়ায় ছোট ব্যবসায়িরা তাদের কাছ থেকে এসব গুড় কিনে বাজারে সরবরাহ করছে।
ফরিদপুর জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারি পরিচালক সোহেল শেখ বলেন, এ ব্যপারে তাদের নজরদারি রয়েছে। তবে বাজারে যারা গুড় বিক্রি করে তারা স্বীকার করে যে চিনি দিয়েই গুড় বানান। ভেজাল গুড় তৈরির উৎসের কোনো সন্ধান থাকলে তিনি তথ্য দিয়ে সহায়তার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জিয়াউল হক বলেন, ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ থাকায় বর্তমানে খেজুর গাছ নিধন কমেছে। তাই এবার জেলায় আগের চেয়ে বেশি রস ও গুড় পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। গাছিরা যেন খেজুর গাছ কেটে রসের সদ্ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এতে ফরিদপুরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী।