পুলিশ কি চাইলেই মোবাইলফোন তল্লাশি করতে পারে?

Slider তথ্যপ্রযুক্তি


পুলিশের এরকম তল্লাশি ও মোবাইলফোন চেক করার ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
পুলিশ কি চাইলেই মোবাইলফোন তল্লাশি করতে পারে?

বিএনপির ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন আগে থেকেই পুলিশের পাহারা এবং তল্লাশি শুরু হয়। কিন্তু ঢাকায় আসা অনেক নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন পুলিশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও তাদের তল্লাশি করেছেন। এ সময় তাদের মোবাইলফোন খুলে ফটোগ্যালারি তল্লাশি করা হয়েছে বলে অনেক নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন। কিন্তু চাইলেই কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোনো ব্যক্তি অন্য আরেকজনের মোবাইলেরফোনের মতো ব্যক্তিগত জিনিসে তল্লাশি করতে পারে?

বাংলাদেশের আইন কী বলে? এসব ক্ষেত্রে প্রতিকারের কী উপায় রয়েছে?

মোবাইলের ম্যাসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, কললিস্ট তল্লাশি :

রাজবাড়ী থেকে বিএনপির সমাবেশে এসেছিলেন মোহাম্মদ বাবুল। তিনি বলেন, `গাবতলীতে পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবো, কেন ঢাকায় এসেছি। বললাম, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবো। তখন বলে মোবাইল বের করে ছবিগুলো দেখাও। সেখানে কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে।` পুলিশ মোবাইল চেক করছে জানতে পেরে তিনি ঢাকায় আসার আগেই গ্যালারি থেকে দলের ছবি বা ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছিলেন বলেও জানান।

বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন, এভাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তারা পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তল্লাশির শিকার হয়েছেন।

গাজীপুর থেকে ব্যবসায়িক কাজে শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় ফিরছিলেন মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, `আমি কোনো সমাবেশে যাচ্ছিলাম না। ব্যবসার কাজে প্রায়ই গাজীপুরে আসতে হয়। কিন্তু শুক্রবার পথে তিন জায়গায় পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। দুই জায়গায় মোবাইলফোন বের করে ছবি, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছে। এর আগে এমন কখনো হয়নি।`

রোববার আইন ও সালিশ কেন্দ্র একটি বিবৃতিতে বলেছে, `গোপনীয়তা একজন ব্যক্তির সংবিধান স্বীকৃত অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩-এ অধিকারটি নিশ্চিত করা হয়েছে। মোবাইলফোনে মানুষের ব্যক্তিগত ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, তথ্য বা ছবি থাকতে পারে, যা ঘাঁটাঘাঁটি করা একজন ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। এছাড়াও একজন ব্যক্তির গোপনীয়তার সাথে তার মর্যাদার সম্পর্কও জড়িত।`

তল্লাশির নামে হয়রানি প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, `অপরাধীদের ধরতে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। তল্লাশির সময় মোবাইলফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে নিরাপত্তার স্বার্থেই। তবে পুলিশের কোনো সদস্য অহেতুক কাউকে হয়রানি করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।`

পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র ও সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মনজুর রহমান বলেছেন, `নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবেই পুলিশ তল্লাশি বা চেকপোস্ট বসিয়ে থাকে। কাউকে সন্দেহ হলে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে। সেখানেও পুলিশ যা কিছু করেছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই করেছে।` এর বাইরে তিনি আর কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় পথচারীদের মোবাইলফোন তল্লাশির অভিযোগ তুলে একাধিক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, কারো মোবাইলে বিএনপি সংশ্লিষ্ট ছবি বা তথ্য পেলে তাকে মারধর বা পুলিশে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন একজন ভুক্তভোগীর একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করে অভিযোগ করেন, নীলক্ষেত এলাকা থেকে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু ছেলে একজনের মোবাইল, ব্যাগ মানিব্যাগ চেক করে কিছু না পেয়ে জোর করে বিকাশের পিন নিয়ে ১৮ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। এজন্য তিনি ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, `আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরা একটি সাংগঠনিক নির্দেশনা ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। ১০ ডিসেম্বর বিএনপি জামায়াতের নাশকতা আগুন সন্ত্রাসের চেষ্টা, বোমাবাজির চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক অবস্থান, মিছিল মিটিং এবং রাজু ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অন্যকোনো কর্মকাণ্ডের সাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই।`
পুলিশ চাইলেই মোবাইল তল্লাশি করতে পারে না

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, `মোবাইলফোন পুরোপুরি একজনের ব্যক্তিগত একটি যন্ত্র। আদালতের আদেশ ছাড়া কোনোভাবেই সেটা সার্চ করার এখতিয়ার কারো নেই। কারণ এই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে তাকে দিয়েছে।`

তিনি জানান, তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে বহুদিন যাবৎ ব্রিটিশ আমলের আইন অনুসরণ করে করা হলেও ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিনা পরোয়ানায় (৫৪ ও ১৬৭ ধারায়) গ্রেফতার ও রিমান্ডের ক্ষেত্রে ১৫টি নির্দেশনা জারি করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে কিছু সংশোধন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশ বহাল রাখেন।

সেখানে বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সন্দেহেরবশে কাউকে তল্লাশি করা দরকার মনে করলে সেটা ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে সাক্ষীর উপস্থিতিতে করবেন। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র দেহ তল্লাশির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, `মোবাইল হচ্ছে খুব পার্সোনাল একটি গ্যাজেট, যেটা মালিকের পারমিশন ছাড়া ধরার কারো আইনগত এখতিয়ার নেই। যদি কোনো মামলার অংশ হিসেবে মোবাইলফোন আদালতে উপস্থাপন করা হয় তখন আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তকারী ব্যক্তিরা সেটা দেখতে পারবে। এছাড়া আর কোনোভাবে সুযোগ নেই। এর বাইরে গিয়ে কিছু করলে সংবিধানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, সেটার গুরুতর লঙ্ঘন হবে।। একপ্রকার ফৌজদারি অপরাধের মধ্যেও পড়বে।

আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোবাইফোন দেখতে চাইলে যেকোনো নাগরিক তাতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। কারণ আইন অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশ ছাড়া তারা সেটা করতে পারেন না। তবে তিনি এও স্বীকার করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম কোনো উদাহরণ নেই।

বড়ুয়া বলেন, `যেহেতু এটা একপ্রকার হয়রানি, সেজন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। অথবা তিনি ফৌজদারি মামলাও করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে আসলে এরকম প্র্যাকটিস নেই।`

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সান বার্নার্দিনোর ব্যবহৃত আইফোনের লক খোলার জন্য এফবিআইয়ের অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হবে জানিয়ে রাজি হয়নি অ্যাপল। এরপর সংস্থাটি আদালতে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত শুনানির আগে থার্ড পার্টির সহায়তায় ফোনের তথ্য উদ্ধার করে সংস্থাটি।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *