রাজধানী ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ কেন্দ্র করে গত কিছুদিন ধরে ভেন্যু নির্ধারণ, সংঘর্ষ, হতাহত, দলের মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের মতো নানা ঘটনায় উত্তপ্ত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। বড় কোনো সংঘাতের আশঙ্কায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল সবার মনে। ফলে গতকাল ১০ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বিএনপির কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর সারা দেশের নজর ছিল পরিবর্তিত ভেন্যু সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছে গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশের দিকে। তবে সব ছাপিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই গণসমাবেশ শেষ করেছে বিএনপি। নেতাদের নির্দেশে এদিনই সমাবেশ শেষে দলটির কর্মীরা সবাই যার যার বাড়িও ফিরে গেছেন। ফেরার পথে মুগদা, কমলাপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অসংখ্য ক্যাপ রাস্তার মোড়ে মোড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এর আগে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়, জ্বালানি তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে সব বিভাগীয় শহরে দলটি সমাবেশ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি শেষ হয়। সমাবেশে বিএনপি নেতারা ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন। ঘোষণা আসে সংসদ থেকে বিএনপির এমপিদের পদত্যাগের।
এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর দেশজুড়ে গণমিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সমাবেশে সরকারের দমনপীড়ন ও গণবিরোধী কার্যক্রম তুলে ধরে প্রধান অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘অতীতে নয়টি সমাবেশ করেছি, সেগুলোতে সরকার বাধার সৃষ্টি করেছে। এ সমাবেশেও সরকার বাধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিভাগের সাধারণ মানুষ সমাবেশে অংশ নিয়ে সরকারের রক্তচক্ষুর জবাব দিয়েছে। জনগণের বার্তা, যারা গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে, তাদের নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যারা অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, তাদের নিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। সে জন্য সারাদেশের জনগণ বার্তা দিয়েছে, তারা এ সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার সরকার এ সমাবেশ বানচাল করতে অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন। যানবাহন বন্ধ করেছে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। আর তারা (সরকার) বলে, নয়াপল্টনের সড়কে যদি বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয় তা হলে নাকি জনদুর্ভোগ হবে। অথচ পাঁচ দিন যাবৎ পল্টনের রাস্তা দিয়ে মানুষ যেতে দেয় না, গাড়ি চলে না, দোকানপাট, বিপণি বিতান, মার্কেট বন্ধ। এ দুর্ভোগ কে সৃষ্টি করল? আমরা আগে বলেছি, আমরা কোনো কাজ গোপনে করি না, প্রকাশ্যে করি। আমরা বলেছি ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে বলব- আপনারা কোন পথে যাবেন। আর যদি না যান আপনাকে তাড়ানোর জন্য, বিদায় দেওয়ার জন্য আমরা সক্রিয়-সচেষ্ট হব।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আজকে এটাই প্রমাণ হয়েছে, জুলুম নির্যাতন করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। ইতিহাস থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পাই। দিবালোকের মতো পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ এই নীতিতে বিশ্বাসী যে আমার ভোট আমি দেব, দিনের ভোট রাতে দেব। আমরা সেটা হতে দেব না।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে নানা বাধা দেওয়া হয়েছে। কারা বাধা দিয়েছে দেশ ও বিশ্ব দেখেছে। যারা আগের রাতে ভোট বাক্স ভরে তারা নাকি গণতন্ত্রী। আসলে গণতন্ত্রী তো বিএনপি। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। নয় বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করে আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বে আবার গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ দুর্নীতিবাজ সরকারের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। কারণ এখন দেশে হালালভাবে উপার্জন করে বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাবেশ করতে এসেছে। তারা জীবন দিয়ে দেশ রক্ষা করবে। বিএনপি সমাবেশ করেছে আর সরকার হরতাল পালন করছে। আজকের সমাবেশ থেকে একটাই শপথ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।’
গণসমাবেশকে ‘ওয়ার্ম ওয়ার্ক’ উল্লেখ করে সামনে শেষ যুদ্ধ হতে চলেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, ‘গত ৭ ডিসেম্বর আমাদের ওপর সরকারের কর্মচারীরা যে হামলা করেছে, তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার চেয়ে কম কিছু নয়। ক্ষমতা বেশিদিন থাকবে না। ইতিহাস পড়েন, শিক্ষা নেন। মানুষ ক্ষেপে গেছে। যত বাধা দেন, যত গুলি করেন, মানুষের কাছে সেটা কিছুই নয়। যার কারণে কাল অনুমতি পাওয়ার পরপর এ মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে।’
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘এই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সফল করে আপনারা আজকে সরকারকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন। এ জন্য আপনাদের অভিনন্দন জানাই, সালাম জানাই। একই সঙ্গে বলতে চাই, স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে চাই, এ সমাবেশ শেষ হওয়ার পর আপনারা যার যার বাড়িতে চলে যাবেন।’
এর আগে বিএনপির এ সমাবেশস্থল নিয়ে গত কয়েকদিনের নাটকীয়তা ও টানাপড়েন শেষে শুক্রবার বিকালে গোলাপবাগ মাঠে তা করার অনুমতি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ। জানা গেছে, অনুমতি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গোলাপবাগ মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। গতকাল ভোর থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মাঠের দিকে যাত্রা করেন। সকাল ৮টার আগেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে মাঠ পেরিয়ে নেতাকর্মীরা আশপাশের সড়কেও ছড়িয়ে পড়েন। বেলা ১১টার আগে পশ্চিমদিকে মুগদা-বাসাবো ও কমলাপুর, দক্ষিণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশপাশের গলি, পূর্বদিকে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী, গোপীবাগসহ আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলোও লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। তবে বেলা গড়াতেই রোদ বাড়ায় নেতাকর্মীদের অনেকে মাঠ ছেড়ে আশপাশের সড়কে অবস্থান নেন। কেউ দুপুরের খাবার খেতে বের হয়ে আর মাঠে ফেরেননি, রাস্তায় অবস্থান নেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সমাবেশকালে গোলাপবাগ মাঠসংলগ্ন বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের জলকামান, সাঁজোয়া যান, প্রিজনভ্যান। তবে সমাবেশ এলাকার ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেভাবে দেখা যায়নি।
জানা গেছে, সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার। ঢাকা মহানগরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ঢাকা বিভাগের সব জেলা থেকেই এদিন কম-বেশি নেতাকর্মীরা এসেছিলেন। অন্য বিভাগীয় সমাবেশগুলোর চেয়ে গতকাল ঢাকায় নারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। কৃষক, অটোরিকশা, বাস চালকসহ শ্রমজীবীরাও অংশ নিয়েছেন কর্মসূচিতে। তাদের কেউ কেউ বিএনপি কর্মী, কেউ সমর্থক। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের সন্তানরাও এসেছেন সমাবেশে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। খুলনা থেকে গণসমাবেশ যোগ দিতে এসেছিলেন শাহানা রহমান। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনে তিনি সেøাগান দিচ্ছিলেন। তাকে ঘিরে নেতাকর্মীরাও সেøাগান দিতে থাকেন। তিনি বলেন, বাস বন্ধের শঙ্কা থেকেই খুলনা থেকে সাত দিন আগে ঢাকায় এসেছি।
গোলাম রহমান নামে একজন এসেছেন নেত্রকোনা থেকে। মাথায় ধানের শীষ বেঁধে নিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির সেøাগান দিচ্ছিলেন তিনি। গোলাম রহমান জানান, আমি আমার ভোটের অধিকার ফিরে পেতে এ সমাবেশে এসেছি। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে আসা শাহ আলম বলেন, আমি সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার কথা শুনেই গোলাপবাগের উদ্দেশে বের হয়ে যাই। এসে দেখি কেরানীগঞ্জের পার থেকে খেয়াতে কাউকে নেয় না। অনেক কষ্টে আমি সমাবেশের মাঠে এসেছি। মুন্সীগঞ্জ থেকে শুক্রবার দুপুরে এসেছেন সোহরাব আলী। তিনি বলেন, রাতে মাঠে চাটাইতে ঘুমাইছি। এ এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় রাতে খিচুড়ি ও সকালে নাস্তা করেছি।
সাতক্ষীরা থেকে আসা সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা থেকে ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী এ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। ভোলার মনপুরা থেকে আসা আবদুল মান্নান চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এ সরকারের পতন চাই। দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।
বিএনপি সমাবেশ ঘিরে রাজধানীর প্রবেশ মুখগুলোতে এদিনও ছিল পুলিশের তল্লাশি। এতে ঢাকায় প্রবেশের সময় এসব চেকপোস্টে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে পড়তে হচ্ছে মানুষকে। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আল আমিন সরকার বলেন, প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছেন।