মিশর হলো বিশ্ব পর্যটকদের এক বিস্ময়ের স্থান। সেখানে গেলে কেবল পিরামিডই নয়, দেখার আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য। লোহিত সাগরের পাড়ে চমৎকার সমুদ্রতট, পেছনে রুক্ষ পাহাড়ের সারি। সব মিলে এক মোহনীয় সুন্দর জায়গা মিশরের অবকাশ কেন্দ্র সিনাইয়ের শার্ম আল শেখ। চারদিকে ক্যাফে, বিচ ক্লাব, হোটেল দেখে বোঝা যায় এটি হোটেল, রিসোর্ট আর নাইট ক্লাবের ভালোবাসায় এক অসাধারণ ভ্রমণের স্থান।
২০১৫ সালে মিশরের সিনাইতে রুশ পর্যটকবাহী এক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২২৪ জন আরোহী নিহত হওয়ার পর দেশটির পর্যটনশিল্প বড় সংকটে পড়ে। কমতে থাকে পর্যটক। ফলে মিশরের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। দেশটি খুঁজতে থাকে এর থেকে বের হয়ে আসার উপায়। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সারা বিশে^র কাছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি ও মিশর যে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ তা প্রমাণের উপলক্ষ হিসেবে বিশ^ জলবায়ু সম্মেলনকে বেছে নেয় তারা। গত ৬ থেকে ১৮ নভেম্বর শার্ম আল শেখে ধরিত্রী রক্ষার বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করে দেশটি। সারা বিশে^র ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা জড়ো হয় লোহিত সাগরের তীরের শহরটিতে। ১৯৮টি দেশের মন্ত্রী, এমপি, পরিবেশকর্মী, এনজিওকর্মী, সাংবাদিকসহ প্রায় ৫০ হাজার প্রতিনিধি একত্রিত হয় শার্ম আল শেখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ একশ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অবস্থান করেন শার্ম আল শেখে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে পুরো শার্ম আল শেখ শহরকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। পুরো শহর ঘুরলে আপনি দেখতে পাবেন পর্যটকদের জন্য বিনোদনের সব পসরা সাজিয়ে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শার্ম আল শেখে রয়েছে সমুদ্র উপকূল আর সে কারণেই বুঝি বা এলাকাটি হয়ে গেছে মিশরের সব রকম জলক্রীড়ার প্রাপ্তিস্থান। যে জলক্রীড়ার নামই আপনি নিন না কেন, শার্ম আল শেখে তার দেখা পাবেনই।
শার্ম আল শেখের আরেক আকর্ষণ রাস মোহামেদ ন্যাশনাল পার্ক। সিনাই উপদ্বীপের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত এই ন্যাচার রিজার্ভটি ৪৮০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এখানে পা রাখামাত্র আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না, যখন দেখবেন এর মরুভূমিগুলো, যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ বলতে গেলে পড়েইনি। আরও মোহিত করবে এর সাদা বালির সৈকতগুলো এবং নানা জলক্রীড়ার ব্যবস্থা। এখনকার পানির নিচে যেমন আছে প্রায় এক হাজার প্রজাতির মাছ, তেমনি পানির ওপরে ও নিচে দেখবেন অনেক জাতের কচ্ছপ; গুটিগুটি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষকে ওরা একটুও ভয় পায় না।
শার্ম আল শেখের সব আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্র না’আমাবা বিচকে কেন্দ্র করে। মজা করতে চান, সৈকতে শুয়ে-বসে একটি দিন কাটিয়ে দিতে চান- সব আপনার হাতের নাগালেই, শুধু টাকা খরচের মন থাকলেই হবে। একটি কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেই, এখানকার প্রায় প্রত্যেকটি হোটেল, রিসোর্টের নিজস্ব বিচ আছে। সাধারণ পর্যটকদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে কিছু কিছু হোটেলের বিচ আছে যেগুলোতে বাইরের পর্যটকরা নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে প্রবেশ করতে পারবেন। বিচে বসে সমুদ্রের অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি সুরায় চুমুক দিতে পারেন। যেতে পারেন ক্যাসিনো, স্পাতে। নাইট ক্লাবে বারবনিতাদের নাচের ছন্দে কিছুটা আনন্দময় সময়ও কাটিয়ে আসার ব্যবস্থা রয়েছে পুরো শার্ম আল শেখ শহরে।
শার্ম আল শেখের ওল্ড ইজিপ্ট নামক স্থানে অবস্থিত বিখ্যাত আল-মুস্তাফা মসজিদ। অনন্য স্টাইল এবং ভেতরে-বাইরে মনকাড়া স্থাপত্য এই মসজিদকে দিয়েছে বিস্ময়কর সৌন্দর্য। মসজিদ দেখা শেষে যেতে পারেন কপটিক খ্রিস্টানদের হেভেনলি ক্যাথেড্রাল বা গির্জায়। আল-মুস্তাফা মসজিদের কাছে হে এল নূর এলাকায় অবস্থিত গির্জাটির ভেতর-বাইরের দেয়ালে চিত্রিত বাইবেলের কাহিনিভিত্তিক ফ্রেসকো এঁকে দিয়েছে এমন অনন্যতা যে, ২০১০ সালে এক জরিপে এটি বিশ্বের সবচাইতে আকর্ষণীয় দশ গির্জার একটি বলে স্বীকৃতি পায়। ঘুরতে ঘুরতে চলে যেতে পারেন ওল্ড টাউনে। স্থানীয় লোকজন একে অবশ্য ওল্ড মার্কেটই বলে থাকে। এলাকাটি সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও উচ্ছল একটি জায়গা -বর্ণিল, কোলাহলমুখর ও সুগন্ধে ভরপুর। এটি স্থানীয় লোকজনের খুবই প্রিয় স্থান। এ বাজারের প্রধান পণ্য হলো নানা ধরনের ভেষজ ও মসলা। ওল্ড মার্কেটের দোকানে দোকানে এসব পণ্য বোঝাই আর দোকানিরাও অতিশয় ভদ্র। ক্রেতাদের এসব পণ্যের গুণ ও ব্যবহারবিধি বুঝিয়ে বলতে তারা একটুও বিরক্ত হন না।
শার্ম আল শেখ ভ্রমণে আপনি যেতে পারেন ডলফিনেলায়। নাম শুনেই হতো আন্দাজ করতে পারছেন ব্যাপারটা কী। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ডলফিনের সঙ্গে খেলা। এখানে আপনি ডলফিনের সাথে সাঁতার কাটতে আর তাদের পিঠে চড়তে পারবেন। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। কেনাকাটা ও বিনোদনের জন্য শার্ম আল শেখের আরেকটি আকর্ষণীয় জায়গা হলো সোহো মার্কেট। বিশ্বের সব নামিদামি ব্র্যান্ডের জিনিস এখানে পাবেন। এ ছাড়া বিনোদনের সব ব্যবস্থা এখানে আছে।
বলা হয়, রাত যত গভীর হয়, শার্ম আল শেখের সৌন্দর্য তত বাড়তে থাকে। এখানে মরুভূমিতে রাতের আকাশ ও তারার মেলা না দেখে আপনি কিছুতেই শহর ছেড়ে যেতে চাইবেন না। ওখানে গেলে আপনি প্রথমেই ঐতিহ্যবাহী বেদুইন আতিথেয়তার স্বাদ পাবেন। সন্ধ্যাটা শুরু হবে একটি মিশরীয় তাঁবুতে মোমবাতির আলোয় জম্পেশ খানাপিনার মধ্য দিয়ে। সূর্য একেবারে ডুবে গেলে, চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে এবং আকাশে একটি-দুটি তারা ফুটে উঠতে শুরু করলে আপনার গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে অনেকগুলো টেলিস্কোপ রাখা আছে এমন এক জায়গায়। সেই টেলিস্কোপে চোখ রেখে আপনি দেখবেন রাতের আকাশে তারার মেলা। সে এক অভাবিত দৃশ্য, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আমার বারো দিনের মিশর সফরের ৮ দিন কেটেছে শার্ম আল শেখ শহরে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো শহর। কৃত্রিমভাবে পুরো শহরকে তৈরি করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন সফলভাবে আয়োজনের মাধ্যমে মিশর বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পেরেছে যে, মিশর তথা শার্ম আল শেখ নিরাপদ। রাতের আলোর ঝলকানি আর সব রকম সুবিধা নিয়ে সৌন্দর্য নিয়ে শার্ম আল শেখ শহর যেন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।