মাওয়া-জাজিরা ঘুরে: ‘শুনেছিতো হংকং-সিঙ্গাপুরের মতো করে দেওয়া হবে গোটা এলাকা। পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মাসেতুর দুই পাড়। আমরাতো সেই অপেক্ষাতেই আছি।’
জাজিরার মাঝি ঘাটে নতুন ফার্মেসি বসিয়েছেন আবুল হাসান। এই অপেক্ষা তারই।
ব্যবসায় আইডিয়া ভালো আবুল হাসানের। বছরখানেক আগে মাঝি ঘাটে যখন সেতুর জন্য নদী ড্রেজিংয়ের কাজ চলছিলো তখনই তার মনে হয়েছে মাঝি ঘাটে একটা ফার্মেসি ভালো চলবে।
জানালেন, ডেজিংয়ে শত শত শ্রমিক। মাথাব্যথা, পেটের পিড়ার মতো সাধারণ রোগ, কাঁটা-ছেঁড়ার মতো কিছু সাধারণ দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। ফলে ফার্মেসিতে ক্রেতার চাপ থাকেই। আয়ও খারাপ না। ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি এখন চলছে মূল সেতু নির্মাণের কাজ, চলছে নদী শাসনের কাজও ফলে ক্রেতা আছে, ব্যবসা ভালো।
কিন্তু সেতু হয়ে যাওয়ার পর কী হবে?
তারই উত্তর আবুল হাসানের, ‘শুনেছিতো হংকং-সিঙ্গাপুরের মতো করে দেওয়া হবে গোটা এলাকা।’
যুবক হাসানের চোখে মুখে স্বপ্ন, পদ্মাসেতু নদীর ওপারের জনপদকে করে তুলবে উন্নত। এখানেই গড়ে উঠবে নতুন শহুরে জনপদ। সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা এলাকাটি গড়ে উঠবে পর্যটন এলাকা হিসেবে।
পদ্মাপাড়ে রিসোর্ট হবে। নদী তীরে তৈরি হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের নানা স্থাপনা। নদীর ভেতরে নৌযানে ভ্রমণ করতে আসবেন ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। আর সেতুই তো হয়ে থাকবে অন্যতম এক আকর্ষণ।
পদ্মা সেতুর পাড়ে হবে নান্দনিক শহর সে ঘোষণা সরকার আগেই দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা নানা সময়ে তাদের বক্তৃতায় বলেছেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে তোলা হবে ‘মিনি সিঙ্গাপুর’। পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় হবে পর্যটন কেন্দ্র। সরকার যে নতুন একটি বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা করছে সেটিও হতে যাচ্ছে পদ্মার ওপারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পদ্মার দুই তীরে হংকংয়ের আদলে নগরায়ন করা হবে। ২০১৪ সালের ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব-কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় এ কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেছিলেন, পদ্মাতীরের এই নগরীতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন কেন্দ্র, বাণিজ্য ও বিনোদন কেন্দ্র। সেখানে একটা উন্নত-অত্যাধুনিকমানের কনভেনশন সেন্টার করা হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য মেলা করারও ব্যবস্থা রাখা হবে।
এছাড়াও সম্প্রতি পদ্মার ওপারে নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণেরও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
পদ্মাতীরে এমন নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যেও কাজ শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে জানালেন ফিরোজ ব্যাপারী নামে একজন। সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটি ফেলার ঠিকাদারি করছেন তিনি। ফিরোজ জানালেন পদ্মাসেতুর জাজিরা পাড়ে রিসোর্ট তৈরির জন্য জমি নির্ধারণ করে তাতে মাটি ফেলার কাজ চলছে। বিশাল এলাকা জুড়ে এই রিসোর্ট পর্যটকদের আকর্ষণ করে নিয়ে আসবে।
পর্যটনের এই প্রত্যাশা নদীর মাওয়া অংশের বাসিন্দাদেরও। তারাও মন্ত্রীদের আশ্বাসের কথা স্মরণ করলেন। মাওয়া ঘাটে স্পিডবোটের ইজারাদার হাজি মোহাম্মদ হারুনর রশিদ বললেন, এই তো সেদিনও যোগাযোগমন্ত্রী এসে বলে গেলেন পর্যটন কেন্দ্র হবে গোটা মাওয়া এলাকা।
ঘাটের স্পিডবোটগুলো তখন পর্যটনে ব্যবহৃত হবে বলেই প্রত্যাশা হাজি রশিদের। তিনি বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পদ্মাসেতু দেখতে আসবেন তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেই ব্যবহৃত হতে পারবে এসব স্পিড বোট।
পর্যটন ছাড়াও নানাভাবে অর্থনৈতিক পথে অগ্রসর হবে মাওয়া ও জাজিরা, এমনই স্বপ্ন দুই পাড়ের বাসিন্দাদের। সেতুর গতি, গতি সঞ্চার করবে তাদের ভাগ্য বদলেরও।
বড় বড় নান্দনিক ও বিষ্ময়ের সেতুকে ঘিরে পর্যটন রিসোর্ট গড়ে ওঠে এমনটাই দেখা যায় বিশ্বের দেশে দেশে। বাংলাদেশেও যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন। সেখানে তৈরি হয়েছে রিসোর্ট, যা অনেক মানুষেরই আকর্ষণ। যমুনার ওপর দিয়ে ওই ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বিশ্বের একাদশ বৃহত্তম সেতু।
ভারতের দিল্লির ওয়াজিরাবাদে নির্মাণাধীন সিগনেচার সেতু তার নকশার কারণেই হয়ে উঠবে এক বড় আকর্ষণ। এছাড়াও দেশটির সরকার এই সেতুকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলারও নানা উদ্যোগ রয়েছে।
লন্ডনের টেমস নদীর ওপর লন্ডন ব্রিজকেতো নামই দেওয়া হয়েছে ব্রিজ অব ট্যুরিজম। কলকাতার হাওড়া ব্রিজকে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটকের আকর্ষণ হিসেবে।
এছাড়াও লাওসের মেকং ব্রিজ, নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হারবার এসবগুলোই পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে স্রেফ ব্রিজকে ঘিরে।
পদ্মাসেতু ঘিরেও এমন পর্যটনই শুধু না নগরায়ন হবে সে অপেক্ষাতেই এখন নদীর দুই তীরের বাসিন্দারা।